কিন্তু আর তো চলবে না, কোনো ছিদ্রে আসল কথাটা পাড়তেই হবে। পিক্নিকের এক অবকাশে অধ্যাপক যখন পোড়ো মন্দিরের সিঁড়িটাতে বসে নব্য কেমিস্ট্রির নতুন-আমদানির বই পড়ছিলেন, বেঁটে আবলুস গাছের ঝোপের মধ্যে ব’সে অচিরা হঠাৎ আমাকে বললে, “এই চিরকালের বনের মধ্যে যে একটা অন্ধ প্রাণের শক্তি আছে, ক্রমেই তাকে আমার ভয় করছে।”
আমি বললুম, “আশ্চর্য, ঠিক এইরকমের কথা সেদিন আমি ডায়ারিতে লিখেছি।”
অচিরা বলে চলল, “পুরনো ইমারতের কোনো-একটা ফাটলে লুকিয়ে লুকিয়ে অশথের একটা অঙ্কুর ওঠে, তার পরে শিকড়ে শিকড়ে জড়িয়ে ধ’রে তার সর্বনাশ করে, এও তেমনি। দাদুর সঙ্গে এই কথাটাই হচ্ছিল। দাদু বলছিলেন, ‘লোকালয় থেকে বহুদিন একান্ত দূরে থাকলে মানবচিত্ত প্রকৃতির প্রভাবে দুর্বল হতে থাকে, প্রবল হয়ে ওঠে আদিম প্রাণপ্রকৃতির প্রভাব।” আমি বললুম, “এরকম অবস্থায় কী করা যায়।” তিনি বললেন, “মানুষের চিত্তকে আমরা তো সঙ্গে করে আনতে পারি— ভিড়ের চেয়ে নির্জনে তাকে বরঞ্চ বেশি করে পাই, এই দেখো-না আমার বইগুলি।” দাদুর পক্ষে বলা সহজ, কিন্তু সবাইকে এক ওষুধ খাটে না। আপনি কী বলেন।”
আমি বললুম, “আচ্ছা, বলব। আমার কথাটা ঠিকমত বুঝে দেখবেন। আমার মত এই যে, এইরকম জায়গায় এমন একজন মানুষের সঙ্গ সমস্ত অন্তর বাহিরে পাওয়া চাই, যার প্রভাব মানবপ্রকৃতিকে সম্পূর্ণ করে রাখতে পারে। যতক্ষণ না পাই ততক্ষণ অন্ধশক্তির কাছে কেবলই হার ঘটতে থাকবে। আপনি যদি সাধারণ মেয়েদের মতো হতেন, তা হলে আপনার কাছে সত্য কথা শেষ পর্যন্ত স্পষ্ট করে বলতে মুখে বাধত।”
অচিরা বললে, “বলুন আপনি, দ্বিধা করবেন না।”
বললুম, “আমি সায়ন্টিস্ট, যেটা বলতে যাচ্ছি সেটা ইম্পার্সোনাল ভাবে বলব। আপনি একদিন ভবতোষকে অত্যন্ত ভালোবেসেছিলেন। আজও কি আপনি তাকে তেমনি ভালোবাসেন।”
“আচ্ছা, মনে করুন, বাসি নে।”
“আমিই আপনার মনকে সরিয়ে এনেছি।”
“তা হতে পারে, কিন্তু একলা আপনি নন, বনের ভিতরকার এই ভীষণ অন্ধশক্তি। সেইজন্যে আমি এই সরে আসাকে শ্রদ্ধা করি নে, লজ্জা পাই।”