Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://xn--u5bxfcqewdax4kraj7ob.xn--45brj9c)


ব্রহ্মমন্ত্র, ২
ব্রহ্মমন্ত্র
তদেতৎ সত্যং বলিয়াছেন, প্রাচীন ব্রহ্মজ্ঞদের পক্ষে তিনি কেবল জ্ঞানলভ্য একটি দার্শনিক তত্ত্বমাত্র ছিলেন না। একাগ্রচিত্ত ব্যাধের ধনু হইতে শর যেরূপ প্রবলবেগে প্রত্যক্ষ সন্ধানে লক্ষের দিকে ধাবমান হয়, ব্রহ্মর্ষিদের আত্মা সেই পরমসত্যের মধ্যে প্রবেশ করিয়া তন্ময় হইবার জন্য সেইরূপ আবেগের সহিত ধাবিত হইত। কেবলমাত্র সত্যনিরূপণ নহে, সেই সত্যের মধ্যে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ তাঁহাদের লক্ষ্য ছিল।

কারণ, সেই সত্য কেবলমাত্র সত্য নহে, তাহা অমৃত। তাহা কেবল আমাদের জ্ঞানের ক্ষেত্র অধিকার করিয়া নাই, তাহাকে আশ্রয় করিয়াই আমাদের আত্মার অমরত্ব। এই জন্য সেই অমৃতপুরুষ ছাড়িয়া আমাদের আত্মার অন্য গতি নাই, ঋষিরা ইহা প্রত্যক্ষ জানিয়াছেন এবং বলিয়াছেন—

স যঃ অন্যম্‌ আত্মনঃ প্রিয়ং ব্রুবাণং ব্রূয়াৎ

অর্থাৎ, যিনি পরমাত্মা ব্যতীত অন্যকে আপনার প্রিয় করিয়া বলেন— প্রিয়ং রোৎস্যতীতি— তাঁহার প্রিয় বিনাশ পাইবে! আমাদের জ্ঞানের পক্ষে যে সত্য সকল সত্যের শ্রেষ্ঠ আমাদের আত্মার পক্ষে তাহাই সকল প্রিয়ের প্রিয়তম—

তদেতৎ প্রেয়ঃ পুত্রাৎ, প্রেয়ো বিত্তাৎ, প্রেয়োহন্যস্মাৎ সর্ব্বসম্মাৎ অন্তরতরং যদয়মাত্মা। এই-যে সর্ব্বাপেক্ষা অন্তরতর পরমাত্মা ইনি আমাদের পুত্র হইতে প্রিয়, বিত্ত হইতে প্রিয়, অন্য সকল হইতে প্রিয়। তিনি শুষ্ক জ্ঞানমাত্র নহেন, তিনি আমাদের আত্মার প্রিয়তম।

আধুনিক হিন্দুসম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁহারা বলেন ব্রহ্মকে আশ্রয় করিয়া কোন ধর্ম্ম সংস্থাপন হইতে পারে না, তাহা কেবল তত্ত্বজ্ঞানীদের অবলম্বনীয়, তাঁহারা উক্ত ঋষিবাক্য স্মরণ করিবেন। ইহা কেবল বাক্যমাত্র নহে— প্রীতিরসকে অতি নিবিড় নিগূঢ় রূপে আস্বাদন করিতে না পারিলে এমন উদার উন্মুক্ত ভাবে এমন সরল সবল কন্ঠে প্রিয়ের প্রিয়ত্ব ঘোষণা করা যায় না। তদেতৎ প্রেয়ঃ পুত্রাৎ প্রেয়ো বিত্তাৎ প্রেয়োহন্যস্মাৎ সর্ব্বস্মাৎ অন্তরতরং যদয়মাত্মা— ব্রহ্মর্ষি এ কথা কোন ব্যক্তিবিশেষে বদ্ধ করিয়া বলিতেছেন না। তিনি বলিতেছেন না, যে, তিনি আমার নিকট আমার পুত্র হইতে প্রিয়, বিত্ত হইতে প্রিয়, অন্য সকল হইতে প্রিয়। তিনি বলিতেছেন আত্মার নিকটে তিনি সর্ব্বাপেক্ষা অন্তরতর— জীবাত্মা মাত্রেরই নিকট তিনি পুত্র হইতে প্রিয়, বিত্ত হইতে প্রিয়, অন্য সকল হইতে প্রিয়— জীবাত্মা যখনই তাঁহাকে যথার্থরূপে উপলব্ধি করে তখনি বুঝিতে পারে তাঁহা অপেক্ষা প্রিয়তর আর কিছুই নাই।

অতএব পরমাত্মাকে যে কেবল জ্ঞানের দ্বারা জানিব তদেতৎ সত্যং তাহা নহে, তাঁহাকে হৃদয়ের দ্বারা অনুভব করিব তদমৃতং। তাঁহাকে সকলের অপেক্ষা অধিক বলিয়া জানিব সকলের অপেক্ষা অধিক বলিয়া প্রীতি করিব। জ্ঞান ও প্রেম-সমেত আত্মাকে ব্রহ্মে সমর্পণ করার সাধনাই ব্রাহ্মধর্ম্মের সাধনা— তদ্ভাবগতেন চেতসা এই সাধনা করিতে হইবে। ইহা নীরস তত্ত্বজ্ঞান নহে, ইহা ভক্তিপ্রতিষ্ঠিত ধর্ম্ম।

উপনিষদের ঋষি যে জীবাত্মামাত্রেরই নিকট পরমাত্মাকে সর্ব্বাপেক্ষা প্রীতিজনক বলিতেছেন তাহার অর্থ কি? যদি তাহাই হবে তবে আমরা তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া ভ্রাম্যমাণ হই কেন? একটি দৃষ্টান্তদ্বারা ইহার অর্থ বুঝাইতে ইচ্ছা করি।

কোন রসজ্ঞ ব্যক্তি যখন বলেন কাব্যরসাবতারণায় বাল্মীকি শ্রেষ্ঠ কবি, তখন এ কথা বুঝিলে চলিবে না যে, কেবল তাঁহারই নিকট বাল্মীকির কাব্যরস সর্ব্বাপেক্ষা উপাদেয়। তিনি বলেন সকল পাঠকের পক্ষেই এই কাব্যরস সর্ব্বশ্রেষ্ঠ— ইহাই মনুষ্য-প্রকৃতি। কিন্ত কোন অশিক্ষিত গ্রাম্য জনপদ বাল্মীকির কাব্য অপেক্ষা যদি স্থানীয় কোন পাঁচালিগানে অধিক সুখ অনুভব করে তবে তাহার কারণ তাহার অজ্ঞতামাত্র। সে লোক অশিক্ষাবশতঃ বাল্মীকির কাব্য যে কি তাহা জানে না এবং সেই কাব্যের রস যেখানে, অনভিজ্ঞতাবশতঃ সেখানে সে প্রবেশ লাভ করিতে পারে না। কিন্ত তাহার অশিক্ষা-বাধা দূর করিয়া দিবামাত্র যখনি সে বাল্মীকির কাব্যের যথার্থ পরিচয় পাইবে তখনি সে স্বভাবতই মানবপ্রকৃতির নিজগুণেই গ্রাম্য পাঁচালী অপেক্ষা বাল্মীকির কাব্যকে রমণীয় বলিয়া