সাহেব সওদাগরেরা বিলাতি কাপড়ের জন্য কেন অত আন্দোলন করিয়াছিলেন আমরা অদ্যপি ভালো করিয়া বুঝিতে পারি নাই। তাঁহাদের সাধুতার অন্তরালে আসল অভিপ্রায় যাহা তাহা অত্যল্প পরিমাণে অনুমান করিতে পারিলেও আমরা এ স্থলে বলিতে চাই না। পরন্তু স্বদেশভক্ত সম্প্রদায় সে করের জন্য কেন অত ‘উতলা’ হইয়াছিলেন তাহাও বুঝি কঠিন। তাঁহাদের অধৈর্যের একটা কারণ আমরা উপরেই নির্দেশ করিয়াছি। তাহা হুজুক ‘হবি’ ভিন্ন আর কিছুই না। কেহ কেহ বলিতে পারেন যে, বিলাতি কাপড়ে মাশুল হইলে, কাপড়ের দেশী কলওয়ালাদিগের সুবিধা হইবে, দেশের শিল্পোন্নতি হইবে এই অনুমানেই স্বদেশহিতৈষীরা আমদানি-করের আকাক্ষা করিয়াছিলেন। কিন্তু এ কথা কার্যত কোনো কথাই নয়। কেননা আমদানি-কর হইলে ‘এক্সইস’ করও হইবে ইহা উভয় পক্ষে অঙ্গীকারই করা হইয়াছিল। এ সম্বন্ধে সুপ্রিম কাউন্সিলের সন্মাননীয় সদস্য মি. ফাজুলভাই বিশরামের ইংরাজি উক্তি আমরা ফুটনোটে উদ্ধৃত করিয়াছি। তিনি বলিয়াছিলেন, ‘আমি নিজে কাপড়ের কলের স্বত্বাধিকারী তথাচ বিলাতি কাপড় সুতার উপর আমদানি করের আকাঙ্ক্ষায় এ-দেশীয় কাপড় সুতায় শুল্ক সংস্থাপনে সন্মত হইতেছি’।
পরন্তু আমদানি-করে হস্তনির্মিত দেশীয় বস্ত্রশিল্পের উন্নতিকল্পনা কেবল বিড়ম্বনা ব্যতীত আর কিছুই নয়। এরূপ বিড়ম্বনাময়ী বিচিত্র কল্পনা কেবল মরীচিকাপ্রলুব্ধ পেট্রিয়টি মস্তিষ্কেই উদ্ভূত হওয়া সম্ভবে। ক্ষুদ্র লোকের এমনি বৃহৎ কল্পনা করা সাধ্য নহে। তাঁতি রাজা মান্ধাতার আমলের আর্য-তাঁতে বিভুদ্ধ বস্ত্র বয়ন করে; সে বস্ত্র মাঞ্চিস্টারের ম্লেচ্ছভাবাপন্ন নহে; অতি উত্তম কথা। পরন্তু সেই বিশুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করিয়া পূতাত্মা আর্যসন্তানদিগের সন্ধ্যাহ্নিক আওড়াইবার অতিরিক্ত সুবিধা হইতে পারে। ইহা আরও উত্তম। কিন্তু এই যে আর্য-তাঁতের বিশুদ্ধ বস্ত্র ইহাতে সূত্র কাহার? সুতা কোথা হইতে আসে সে সংবাদ কি সত্য সত্যই আপনারা কেহ রাখেন না? চিক্কণ চটক্দার কালাপেড়ে পরিয়া তাহার উপর অভ্র ইস্তিরির অতি সূক্ষ্ম উড়ানি উড়াইয়া তুমি যে দেশী বস্ত্রের বাহার দেখাও সুতা কিন্তু তাহার বিলাতি। বিলাতি সুতা ব্যতীত, তোমার দেশী বস্ত্রের বাবুগিরি গলিয়া যায়; দেশী তাঁতির তাঁত শিকায় উঠে। বোম্বায়ের কলে জোর ২৪ নম্বরের সূত্র অবধি জন্মে, তাহার অধিক সূক্ষ্ম সূত্র জন্মে না; কিন্তু তোমার বাবুয়ানার উপকরণ ও গৃহিণীর লজ্জানিবারণের (!) জন্য বস্ত্রটা ৮০ নম্বরেরও অতিরিক্ত সূক্ষ্ম সূত্রে প্রস্তুত হইলে ভালো হয়; সে-সব সূত্র বিলাত হইতেই আসিয়া থাকে। দেশী তাঁতি বিলাত সূত্রের দ্বারাই বস্ত্র বোনে। অতএব বিলাতি সূত্রে শুল্ক বসিয়া দেশীয় বস্ত্রের শিল্পোন্নতি কোন্ ঐন্দ্রজালিক মন্ত্রবলে হইবে তাহা আমরা আদৌ বুঝিতে অক্ষম। ট্যারিফ শুল্কে বিলাতি বস্ত্রের মূল্যাধিক্যের অনুপাতে দেশী বস্ত্রের মূল্যও দারুণ বৃদ্ধি হইবে; কেননা বিলাতি সূত্রে দেশী বস্ত্র নির্মিত; সূত্রের মূল্য বৃদ্ধি হইলেই বস্ত্রের মূল্য বৃদ্ধি হয়। অতএব এরূপ স্থলে লোকে বিলাতি কাপড় (তাহার মূল্য আমদানি শুল্কে এখনকার অপেক্ষা বাড়িলেও) ছাড়িয়া তদপেক্ষা চতুর্গুণ অধিক মূল্যের দেশী বস্ত্র কিনিতে চাহিবে কেন? আর পেট্রিয়টিজমের অনুরোধে তাহা চাহিলেও তত পয়সা পাইবে কোথায়? পেট্রিয়টিক স্পিরিটে তো আর উলঙ্গ হইয়া থাকা চলে না। বলিবে ‘বোম্বাই কলের কাপড় পরিবে। বঙ্গদেশেও কাপড়ের কল হইতেছে’। বঙ্গীয় কলের বস্ত্র আজও বাহির হয় নাই; হইলেও তাহা এবং বোম্বাই কলের বস্ত্র, বিলাতি বস্ত্রের অপেক্ষা এক কাক্রিও সস্তা হইবে না; বরং এক আনা
১) সুপ্রিম কাউন্সিলের বেসরকারি সদস্য মাননীয় শ্রীযুক্ত ফাজুলভাই বিশরাম বলিয়াছিলেন : I, for one, speaking as a mill owner, would be willing to support the levying of an excise duty on cotton goods manufactured in India, assuming of course that such an import can be practically levied without injustice and serious trouble.