এ দেশে ইংরাজের আমলে বস্ত্রকর বহুকালই ছিল না। খৃ. ১৮৫৯ সালে এই কর প্রবর্তিত হয়। আমদানি কাপড় ও সুতার উপর শতকরা পাঁচ টাকা হারে শুল্ক বসে। এবং সেই হিসাবে ওই শুল্ক পাঁচ বৎসর পর্যন্ত চলে। ১৮৬৪ সালের ২৩ আইনে উহা পাঁচ টাকা হইতে শতকরা সাড়ে সাত টাকায় উঠে। ১০/১১ বৎসর পরে ১৮৭৫ সালের ১৬ আইনে উহা পুনঃ পাঁচ টাকায় পরিণত হয়। ১৮৮২ সালে এই শুল্ক একেবারেই উঠিয়া যায়। ১৮৮২ সালের ১১ আইনে ট্যারিফ ট্যাক্স সম্পূর্ণরূপে রহিত হইয়াছিল এবং অনেকানেক রপ্তানি দ্রব্যের মাশুলও উঠিয়া গিয়াছিল।
আজ আবার বারো বৎসর পরে পুনঃ বস্ত্রকর আসিয়া উপস্থিত। বস্ত্র যখন নিস্কর ছিল তখনই সব লোকে বস্ত্রের ব্যয় কুলাইয়া উঠিতে পারিত না। দেশ এতই দরিদ্র যে, মাঞ্চিস্টারের মহা সুলভ বস্ত্রও সকলে কিনিতে পারে নাই। এই প্রবন্ধের লেখক দেশমধ্যে এমন অনেক পল্লী ও পরগনা দেখিয়াছে যেখানে বারো আনা রকম লোক নির্বস্ত্র। কৃষাণ ও মজুর শ্রেণীর পরিধেয় কেবল অর্ধহস্ত পরিমিত একটি লঙ্গটি মাত্র। ‘শতগ্রন্থি বস্ত্র’ প্রবাদবাক্য; কিন্তু সহস্রাধিক গ্রন্থিযুক্ত জীর্ণ বস্ত্রে ললনা-অঙ্গের লজ্জা আবৃত বা অনাবৃত হইতেও অনেক স্থলে দেখিয়াছি। বস্ত্রের নিস্কর সময়েও অনেক স্থলে অবস্থা এই; অতএব বস্ত্রের উপর কর বসিয়া তাহার মূল্য কিঞ্চিৎমাত্র বাড়িলেও ওই অবস্থা কীরূপ হইবে তাহা কেবল অনুভবনীয়। অন্ন এবং বস্ত্র এই দুইটি দ্রব্য মনুষ্যজীবনে এবং মনুষ্যসমাজে একান্ত অপরিহার্য আবশ্যকীয়; এই দুই সামগ্রী যত সুলভ ও সুপ্রাপ্য হওয়া সম্ভাবিত হইতে পারে, তাহা করা রাজনীতি ও প্রজানীতি উভয়েরই কর্তব্য। মনুষ্য-অস্তিত্বের সর্বপ্রধান উপাদান অন্নবস্ত্রের উপর কোনো কর বসাই উচিত নয়; বিশেষত উহা অতিরিক্ত করের বিষয়ভূত হওয়া ন্যায়ত ও ধর্মত অন্যায়; রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উহা প্রাজ্ঞতারও অনুমোদিত নহে।
এবারকার আইনটি যেরূপ হইল অল্পের মধ্যেই বলা যাইতেছে। বিদেশী ও বিলাতী আমদানি কাপড় ও সুতার শতকরা পাঁচ টাকা কর নির্ধারিত হইয়াছে। ইহা সাবেক সি কাসটাম ট্যারিফ আইনের অন্তর্গত। কিন্তু ইহা ব্যতীত স্বতন্ত্র একটি আইন হইয়াছে, তাহার নাম ১৮৯৪ সালের ‘কটন ডিউটিস্ অ্যাক্ট’। এই আইন আমদানি বস্ত্র শুল্ক আইনেরই অনিবার্য ফল, অগ্রেই বলিয়াছি। কেননা বিদেশী বা বিলাতি বস্ত্র বিক্রয়ের ব্যাবসা করিয়া, গবর্নমেন্ট, স্বাধীন বাণিজ্যের সূত্রানুসারে, এ-দেশীয় কল-শিল্পজাত বস্ত্রপণ্যের বিক্রয় সংরক্ষণ করিতে সমর্থ নহেন। সুতরাং এ-দেশীয় কলের কাপড়ের উপর কর বসাইতে বাধ্য। সেই কর বসাইবার জন্যই এই ‘কটন ডিউটিস্ অ্যাক্ট’। বিলাতি বস্ত্রে শুল্ক না বসিলে এ অ্যাক্ট বা আইন নিশ্চয়ই হইত না। এই আইন অনুসারে দেশী কলের সুতার উপর কর বসিল। সুতার শুল্কের অর্থই বস্ত্রের কর; কারণ যে সুতার বস্ত্রে বয়ন হইবে সে সুতারও শুল্ক লাগিবে; সুতরাং বোনা বস্ত্রের উপর কর না বসিয়া অবোনা সুতার উপরেই শুল্ক হইয়াছে। অর্থ একই। করের হার আমদানি-করেরই সমান অর্থাৎ শতকরা পাঁচ টাকা করিয়াই হইয়াছে। তবে ইহার মধ্যে একটু কথা এই যে, দেশী কলে হয় মোটা সুতা; বিলাতি কলে জন্মে সরু সুতা। বোম্বে অঞ্চলের কল, বিলাতি কলের সরু সুতার সহিত বড়ো বেশি প্রতিযোগিতা করে না। যে পরিমাণে প্রতিযোগিতা সেই পরিমানেই কর বা আইন প্রয়জন। অতএব দেশী কলে যে পরিমাণে অপেক্ষাকৃত ও অত্যল্প সরু সুতা উৎপন্ন হয়; তাহারই উপর কর বসিয়াছে। অর্থাৎ দেশী কলে ২০ নম্বরের সুতার ও তন্নিম্ন শ্রেণীর সুতার কর লাগিবে না; ২১ নম্বর হইতে তদূর্ধ্ব নম্বরের সরু সুতারই শুল্ক লাগিবে। গবর্নমেন্ট যদি কখনো ইচ্ছা করেন অর্থাৎ ইহার পর অতিরিক্ত তথ্য সংগৃহীত হইয়া প্রতিপন্ন হয় যে, এ-দেশীয় কলে ২০ নম্বরের সুতা অপেক্ষা সূক্ষ্ম সুতা প্রস্তুত হয় না; তাহা হইলে আইন একটু সংশোধিত করিবেন; ২০ নম্বর ২৪ নম্বরে পরিণত হইবে। অর্থাৎ ২৪ নম্বর পর্যন্ত সুতার শুল্ক লাগিবে না, তদূর্ধ্ব হইলেই তাহা লাগিবে। পরন্তু, এ-দেশীয় কল হইতে যে-সকল সুতা অন্য দেশে রপ্তানি হইবে, তাহার শুল্ক লাগিবে না; দেশমধ্যে যে-সকল সুতা বিক্রয় হইবে এবং দেশমধ্যে বিক্রয়ে বস্ত্র যে-সকল সুতায় প্রস্তুত