Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://xn--u5bxfcqewdax4kraj7ob.xn--45brj9c)


পরিশিষ্ট-৩২
পরিশিষ্ট

সেইজন্য আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত লোক এবং বিলাত-ফেরতরা সাধারণ লোকদের হইতে আপনাদিগকে যেন স্বতন্ত্রশ্রেণীভুক্ত করিয়া রাখিতে ভালোবাসেন। বাহ্য বেশভূষা আচারব্যবহারেও তাঁহারা আপনাদের পার্থক্য কিছু যেন অস্বাভাবিক আড়ম্বরের সহিত জাহির করিয়া রাখিতে চান।

কতকটা পার্থক্য যে আপনিই হইয়া পড়ে সে কথা অস্বীকার করিবার জো নাই। ইংরাজি-শিক্ষিত এবং ইংরাজিতে অশিক্ষিত লোকদের মধ্যে যে কেবল শিক্ষার তারতম্য তাহা নহে, শিক্ষার শ্রেণীভেদ বর্তমান। পরস্পরের বিশ্বাস সংস্কার রুচি এবং চিন্তা করিবার প্রণালী ভিন্ন রকমের হইয়া যায়। এবং ইংরাজি-শিক্ষিত ব্যক্তি আপনাদিগকেই শিক্ষিত ও শ্রেষ্ঠ এবং অপরসাধারণকে অশিক্ষিত এবং পশ্চাদ্‌বর্তী না মনে করিয়া থাকিতে পারে না।

জ্ঞানস্পৃহা ও রসবোধ, বুদ্ধি এবং কল্পনা, সাহস ও বাহুবল, অধ্যবসায় ও আত্মসম্মানে য়ুরোপীয় জাতির যে এক মহোচ্চ আদর্শ ইংরাজি শিক্ষা আমাদের মনে জাজ্বল্যমান করিয়া তুলিতেছে তাহার যদি কোনো আকর্ষণ না থাকিবে তবে আমাদের শিক্ষাকে ধিক্‌!

সেই আকর্ষণ আমাদিগকে অনেক সময় ছদ্মবেশ এবং আত্মপ্রতারণায় লইয়া যায়। কেবল ইংরাজি শিখিয়াই আমরা যেন ইংরাজের মহত্ত্বকে কতকটা আপনার বলিয়া মনে করি, এবং যাহারা ইংরাজি শেখে নাই তাহাদিগকে কতকটা বাহিরের লোকের মতো করিয়া দেখি। ইংরাজের মহত্ত্ব যে ঐতিহাসিক, তাহা যে বংশপরম্পরাগত, কর্মগত, চরিত্রগত– ইংরাজের ভাষা সাহিত্য বিজ্ঞান যে সেই ইতিহাস, সেই চরিত্র হইতে উদ্ভুত হইয়াছে– তাহা যে শুদ্ধমাত্র স্কুলে অধ্যয়ন এবং পরীক্ষা পাস হইতে নহে– ইহা আমরা চোখ বুজিয়া ভুলিতে ইচ্ছা করি। এবং ইংরাজের স্কুলে পড়িয়াছি বলিয়াই আমরা নিজেকে ইংরাজশ্রেণীয় জ্ঞান করি।

এইরূপ ইংরাজের টানে দেশ হইতে পৃথক হইয়া যাইবার যে ভাব আমাদের মধ্যে দেখা যাইতেছে তাহা কোনো এক পক্ষের মধ্যে বদ্ধ নহে; তাহা নানা আকারে নানা দিক হইতে প্রকাশ পায়। মুখুজ্জেমশায় এবং বাঁড়ুজ্জেমশায় কেহই তাহা হইতে পরিত্রাণ পান নাই।

আজকাল জমিদারবর্গ ইংরাজের মুখ না তাকাইয়া, উপাধির দিকে লক্ষ না রাখিয়া দেশহিতকর কোনো কাজে প্রবৃত্ত হইতে চান না– দেশের লোকের স্তুতিনিন্দা তাঁহাদের কাছে এতই ক্ষুদ্র হইয়া গেছে।

তেমনি আমাদের দেশে যাঁহারা জননায়ক বলিয়া সর্বদা সভামঞ্চের উপরে আরোহণ করেন তাঁহাদেরও ভাবগতিক দেখিয়া আমাদের মনে আশ্বাস হয় না। বরঞ্চ আমাদের জমিদারদিগকে দেখিতে শুনিতে ঠিক আমাদের দেশের লোকের মতো, কিন্তু আমাদের জননায়কদের অনেকেই যে দেশের মুরুব্বি বলিয়া আপনাদিগকে প্রচার করেন সে দেশকে আচারে ব্যবহারে জীবনযাত্রায় অহরহ অপমানিত করেন। ইংরাজরাহুকর্তৃক জমিদারদের যদি অর্ধগ্রাস হইয়া থাকে, ইহাদের একেবারে পূর্ণগ্রাস।

জমিদারগণ দেশের জন্য যাহা করেন তাহা গবর্মেন্টের মুখ তাকাইয়া, ইঁহারা যাহা করেন তাহাও ইংরাজের প্রতি লক্ষ রাখিয়া। তাহার ভাষা ইংরাজি, তাহার প্রণালী ইংরাজী, তাহার প্রচার ইংরাজিতে। ইংরাজ-দৃষ্টির প্রবল আকর্ষণ হইতে ইঁহারা আপনাদিগকে প্রাণ ধরিয়া বিচ্ছিন্ন করিতে পারেন না।

এই স্থলে আমাদের কোনো বন্ধুর লেখা হইতে নিন্মলিখিত সংবাদটি আমরা উদ্‌ধৃত করি–

স্বর্গীয় ভূদেব মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের স্বদেশপ্রীতির বিষয় অনেকেই অবগত আছেন। দুই-তিন বার কন্‌গ্রেস হইবার পর একজন ভদ্রলোক তাঁহাকে কন্‌গ্রেস সম্বন্ধে অভিপ্রায় জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বলেন, 'ভারতবর্ষ একটা মহাদেশ; এই মহাদেশের অন্তর্গত প্রত্যেক বিভাগের নেতাগণের যত্নে যদি সমস্ত দেশ মিলিত হইতে পারে তাহা হইলে এক মহাজাতির অভ্যুত্থান কল্পনা করিতে পারি বটে, কিন্তু বর্তমান কন্‌গ্রেসওয়ালাদিগের দ্বারা যে তাহা সংসাধিত হইবে না তাহা নিশ্চয় বলা যায়। ইহাদের উদ্যম-আলোচনা-আন্দোলনের ফলে চাই কি আমাদের অনেক অভাব-অবিচার দূর হইতে পারে, কিন্তু রাজার নিকট সুবিচারপ্রাপ্তি কিংবা দুই-এক