
এই-সকল বিরোধ-বিদ্বেষের বাক্য লক্ষ লক্ষ খণ্ড ছাপা হইয়া দেশে বিদেশে বিতরিত হইতেছে। এই প্রাত্যহিক বিষের মাত্রা নিয়মমত পান করিয়া দেশের ক্ষতি হইতেছে সন্দেহ নাই।
প্যাট্রিয়টিজ্ম্ ধর্মনীতি বিজ্ঞান প্রভৃতি কতকগুলি বাঁধি বোল আছে, যাহা লোকে মুখে উচ্চারণ করে এবং সে সম্বন্ধে আর চিন্তা করিবার প্রয়োজন বোধ করে না। সে বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করিতে গেলেই হাতাহাতি বাধিয়া যায়। বাঁধি বোল মুখে মুখে চলিয়া যায়— লোকে নিঃসংশয়ে জীবনযাপন করে। প্যাট্রিয়টিক খুনাখুনি অথবা যোদ্ধৃধর্ম এইরূপের একটা বাঁধি বোল।
য়ুরোপীয় লেখক যে কথা বলিতেছেন তাহার উপরে আমরা আর কী বলিব। তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়া নাই বলিয়া লেখক অনেক দুঃখ করিয়াছেন— আর ইংরাজ ভারতবর্ষীয়ের মধ্যে যে বোঝাপড়ার অভাব দাঁড়াইয়াছে সেজন্য আমাদের কী দুর্গতি ঘটিতেছে তাহা প্রত্যহই প্রত্যক্ষ হইতেছে। প্রাচ্যজাতীয়ের প্রতি, ভারতবর্ষীয়ের প্রতি অবজ্ঞা ইংরাজি সাহিত্যের হাড়ে হাড়ে প্রবেশ করিয়াছে। ইংরাজ বালকদিগকে ইংরাজ-বীরত্বের দৃষ্টান্তে উৎসাহিত করিবার জন্য যে-সকল ছেলেভুলানো গল্প ঝুড়ি ঝুড়ি বাহির হইতেছে তাহাতে ম্যুটিনি-গল্পের উপলক্ষ করিয়া ভারতবর্ষীয়দিগকে রক্তপিপাসু পশুর মতো আঁকিয়া দেবচরিত্র ইংরাজের সহিত তাহাদের পার্থক্য প্রমাণ করিতেছে। ফরাসিকে ইংরাজের ঠিক বুঝিবার উপায় আছে— পরস্পরের আচার ব্যবহার ধর্ম বর্ণ একই প্রকার; কিন্তু আমাদের মধ্যে যথার্থই পার্থক্য বিদ্যমান। সেই পার্থক্য অতিক্রম করিয়া, এমন-কি, সেই পার্থক্যবশতই, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আকর্ষণ কবে ঘটিবে তাহা বিধাতা জানেন। কিন্তু ইতিমধ্যে অত্যুক্তি ও মিথ্যার দ্বারা অন্ধতা অবিচার ও নিষ্ঠুরতা সৃষ্টি করিতেছে।
বস্তুত এই অন্ধতা নেশনতন্ত্রেরই মূলগত ব্যাধি। মিথ্যা দ্বারাই হউক, ভ্রমের দ্বারাই হউক, নিজেদের কাছে নিজেকে বড়ো করিয়া প্রমাণ করিতেই হইবে এবং সেই উপলক্ষে অন্য নেশনকে ক্ষুদ্র করিতে হইবে, ইহা নেশনের ধর্ম, ইহা প্যাট্রিয়টিজ্মের প্রধান অবলম্বন। গায়ের জোর, ঠেলাঠেলি, অন্যায় ও সর্বপ্রকার মিথ্যাচারের হাত হইতে নেশন-তন্ত্রকে উপরে তুলিতে পারে, এমন সভ্যতার নিদর্শন তো আমরা এখনো য়ুরোপে দেখিতে পাই না।
পরস্পরকে যথার্থরূপ জানাশুনা কেমন করিয়া সম্ভব হইবে। নেশনের মেরুদণ্ডই যে স্বার্থ। স্বার্থের বিরোধ অবশ্যম্ভাবী, এবং স্বার্থের সংঘাতে মানুষকে অন্ধ করিবেই। ইংরাজ যদি সুদূর এশিয়ায় কোনোপ্রকার সুযোগ ঘটাইতে পারে ফ্রান্স্ তখনই সচকিত হইয়া ভাবিতে থাকিবে, ইংরাজের বলবৃদ্ধি হইতেছে। প্রত্যক্ষ সংঘাত না হইলেও পরস্পরের সমৃদ্ধিতেও পরস্পরের চিত্তকে বিষাক্ত করে। এক নেশনের প্রবলত্ব অন্য নেশনের পক্ষে সর্বদাই আশঙ্কাজনক। এ স্থলে বিরোধ, বিদ্বেষ, অন্ধতা, মিথ্যাপবাদ, সত্যগোপন, এ-সমস্ত না ঘটিয়া থাকিতে পারে না।
সমাজের পক্ষে উদারতা সহজ। হিন্দুরা বলে, স্ব স্ব ধর্ম পালন করাই পূণ্য। অবস্থাভেদে আচারব্যবহারে পার্থক্য ঘটিতেই পারে এবং সে পার্থক্য পরস্পরের পক্ষে মঙ্গলেরই কারণ, এ কথা শান্তচিত্তে নির্মলজ্ঞানে অনুধাবন করিয়া দেখা যায় এবং ভিন্ন সমাজের প্রতি শ্রদ্ধাসম্মান সম্পূর্ণ রক্ষা করিয়াও স্বসমাজের কর্তব্যপালন করা কঠিন হয় না। সামাজিক উন্নতিতে মানুষের চারিত্রগত উন্নতি হয়— সে উন্নতিতে কাহারও সহিত স্বার্থের বিরোধ ঘটে না। সর্বপ্রকার বিদ্বেষ অসত্য হিংসা সেই উন্নতির প্রতিকূল। সদ্ভাব ও সত্যই সমাজের মূল আশ্রয়। নেশন অনেক সময় ধর্মকে উপেক্ষা ও উপহাস করা আবশ্যক বলিয়া জ্ঞান করে, বাহুবলকে ন্যায়ধর্মের অপেক্ষা বড়ো বলিয়া স্পষ্টতই ঘোষণা করে। সমাজ কদাপি তাহা করিতে পারে না— কারণ, ধর্মই তাহার একমাত্র অবলম্বন, স্বার্থকে সর্বদা সংযত করাই তাহার আত্মরক্ষার একমাত্র উপায়।
আমরা যদি বাঁধি বোলে না ভুলি, যদি ‘প্যাট্রিয়ট’কেই সর্বোচ্চ বলিয়া না মনে করি, যদি সত্যকে ন্যায়কে ধর্মকে ন্যাশনালত্বের অপেক্ষাও বড়ো বলিয়া জানি, তবে আমাদের ভাবিবার বিষয় বিস্তর আছে। আমরা নিকৃষ্ট আদর্শের আকর্ষণে কপটতা প্রবঞ্চনা ও