Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://xn--u5bxfcqewdax4kraj7ob.xn--45brj9c)


পরিশিষ্ট-৩৯
পরিশিষ্ট
অসত্যের পথে পা বাড়াইয়াছি কি না, তাহা চিন্তা করিয়া দেখতে হইবে। এবং ধর্মের দিকে না তাকাইলেও সুবুদ্ধির হিসাব হইতে এ কথা পর্যালোচনা করিতে হইবে যে, ন্যাশনাল স্বার্থের আদর্শকে খাড়া করিলেই বিরোধের আদর্শকে খাড়া করা হয়— সেই আদর্শ লইয়া আমরা কি কোনোকালে য়ুরোপের মহাকায় স্বার্থদানবের সহিত লড়াই করিয়া উঠিতে পারিব?

আমরা লড়াই করিতে পারি জ্ঞানে, ধর্মে। সেখানে আমাদের পৈতৃক মূলধন আছে। সেখানে কেহ আমাদিগকে ঠেকাইবে না— সেখানে পিতৃলোক এবং দেবতা আমাদের সহায় হইবেন এবং বাঁধি বোলে যদি না ভুলি তবে ইহা জানা উচিত যে, সেখানে যে মহত্ত্বের উপাদান আছে তাহা সকল মহত্ত্বের উচ্চে।

কিন্তু এরূপ উপদেশ শুনা যায় যে, প্রকৃতির নিয়ম বিরোধ, অতএব বিরোধের জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে। বাহির যদি আমার বিরুদ্ধ হয় তবে আমিও তাহার বিরুদ্ধ না হইলে বাঁচিতে পারিব না। এইজন্য শিশুকাল হইতে ভিন্নজাতির সহিত বিরোধভাবের একান্ত চর্চাই ‘প্যাট্রিয়টী’র সাধনা। হিন্দুজাতি সেই পোলিটিকাল বিরোধভাবের চর্চাকেই সকল সাধনার অপেক্ষা প্রাধান্য দেয় নাই বলিয়াই নষ্ট হইয়াছে।

পূর্বোক্ত কথাঢি যদি একান্তই স্বীকার করিতে হয় তবে সেইসঙ্গে এ কথাও বলিব, আত্মরক্ষাই মানুষের অথবা লোকসম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্ম নহে। ধর্ম যদি নাশ করে তবে তাহাতেই মাথা পাতিয়া দিতে হইবে।

ন্য্যশনালধর্মেও সকল সময়ে রক্ষা করে না। ক্ষুদ্র বোয়ার জাতি যে লড়িতে লড়িতে নিঃশেষ হইবার দিকে চলিয়াছে— কিসের জন্য? তাহাদের হ্রদয়ে ন্যাশনালধর্মের আদর্শ অত্যন্ত প্রবল হইয়া উঠিয়াছে বলিয়াই। সে ধর্মে তাহাদিগকে রক্ষা করিল কই?

তা ছাড়া বিনাশের চেহারা অনেক সময় ছদ্মবেশী। অনেক সময় পরিপূর্ণ সস্পদ তাহার মুখোশের মতো। কথিত আছে, ক্ষয়কাশে রোগীর কপোলে রক্তিম-লাবণ্য ফুটিয়া উঠে। সম্প্রতি উত্তরোত্তর ব্যাপ্যমান মিলিটারিত্বের রক্তিমায় য়ুরোপের গণ্ডস্থল যে টক্‌টকে হইয়া উঠিতেছে, সে কি স্বাস্থ্যের লক্ষণ? তাহার ন্যাশনালত্বের ব্যাধি অতিমেদস্ফীতির ন্যায় তাহার হ্রদয়কে, তাহার মর্মস্থানকে, তাহার ধর্মনীতিকে আক্রমণ করিতেছে, ইহা কি আমরা প্রত্যহ দেখিতে পাইতেছি না?

অধর্মেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি।

ততঃ সপত্নান্‌ জয়তি সমুলস্ত বিনশ্যতি॥

অধর্মের দ্বারা আপাতত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, কুশল লাভ করে, শত্রুদিগকে জয় করিয়াও থাকে— কিন্তু সমূলে বিনষ্ট হইয়া যায়।

প্রকৃতির নিয়মের প্রতি প্রকৃতিতত্ত্ববিদ্‌ য়ুরোপের যেরূপ অটল বিশ্বাস, ধর্মের প্রতি ধর্মতত্ত্ববিদ্‌ হিন্দু সেইরূপ একান্ত বিশ্বাস প্রকাশ করিয়া পূর্বোক্ত শ্লোক উচ্চারণ করিয়াছেন। কেবলমাত্র প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যভিচারেই যে ধ্রুব মৃত্যু তাহা নহে, ধর্মনিয়মের ব্যভিচারেও ধ্রুব বিনাশ। ধার্মনীতিক নিয়মের অমোঘত্বে য়ুরোপ শ্রদ্ধা হারাইতেছে দেখিয়া, আমরাও যেন না হারাইয়া বসি। আমাদের রাজার এক চোখ কানা বলিয়া আমাদের দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন চোখের উপরে যেন পাগড়ি টানিয়া না দিই।

নদী তাহার দুই তটভূমির মধ্য দিয়া তটহীন সমুদ্রের দিকে চলিয়াছে। নদীকে যদি তাহার তটের মধ্যেই সম্পূর্ণ বদ্ধ করিবার জন্য বাঁধ দেওয়া যায়, তবে তাহা উচ্ছ্বসিত হইয়া তটকে প্লাবিত ও বিনষ্ট করে। প্রাকৃতিক নিয়ম জড় হইতে সচেতনে ধর্মপরিণামের দিকে নিয়ত ধাবিত। সেই পরিণামের দিকে তাহার গতিকে বাধা দিয়া যদি তাহাকে বর্তমানের আদর্শেই একেবারে বাঁধিয়া ফেলা যায়, তবে তাহা ভীষণ হইয়া প্রলয় সাধন করে। স্বার্থে আদর্শ, বিরোধের আদর্শ যতই দৃঢ়, যতই উচ্চ, যতই রন্ধ্রহীন হইয়া ধর্মের গতিকে বাধা দিতে থাকে ততই তাহার বিনাশ আসন্ন হইয়া আসে। য়ুরোপের নেশনতন্ত্রে এই স্বার্থ বিরোধ ও বিদ্বেষের প্রাচীর প্রতিদিনই কঠিন ও উন্নত হইয়া উঠিতেছে। নেশনের মূলপ্রবাহকে অতি নেশনত্বের দিকে, বিশ্বনেশনত্বের দিকে যাইতে না দিয়া, নিজের মধ্যেই তাহাকে বদ্ধ করিবার চেষ্টা প্রত্যহ প্রবল হইতেছে। আগে আমার নেশন, তার পরে বাকি আর-সমস্ত কিছু, এই স্পর্ধা সমস্ত