Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://xn--u5bxfcqewdax4kraj7ob.xn--45brj9c)


পরিশিষ্ট-৪১
পরিশিষ্ট

আর-একটা কথা। বিচারের নিক্তিতে সক্ষম-অক্ষম এবং কালো-সাদায় ওজনের কমবেশি নাই। কিন্তু পোলিটিকাল প্রয়োজন বলিয়া একটা ভারী জিনিস আছে, সেটা যে দিকে ভর করে সে দিকে নিক্তি হেলে। এ দেশে ইংরেজের প্রতি দেশী লোকের অন্ধ সম্ভ্রম একটা পোলিটিকাল প্রয়োজন, অতএব সেরূপ স্থলে সূক্ষ্মবিচার অসম্ভব। ন্যায়বিচারের মতে এ কথা ঠিক বটে যে, ইংরেজের প্রতি দেশী লোক যে ব্যবহার করিয়া যে দণ্ড পায় দেশী লোকের প্রতিও ইংরেজ সেই ব্যবহার করিয়া সেই দণ্ডই পাইবে। আইনের বহিতেও এ সন্বন্ধে কোনো বিশেষ বিধি নাই। কিন্তু পোলিটিকাল প্রয়োজন ন্যায়বিচারের চেয়েও নিজেকে বড়ো বলিয়া জানে।

এ কথা ঠিক বটে, পাশ্চাত্য সভ্যতার আধুনিক ধর্মশাস্ত্রে পলিঢিক্‌স্‌ সর্বোচ্চে, ধর্ম তাহার নীচে। যেখানে পোলিটিকাল প্রয়োজন আসন ছাড়িয়া দিবে সেইখানেই ধর্ম বসিবার স্থান পাইবে। পোলিটিকাল প্রয়োজনে সত্য কিরূপ বিকৃত হইয়া থাকে, অন্য প্রবন্ধে হার্বার্ট্‌ স্পেন্সরের গ্রন্থ হইতে তাহার প্রমাণ উদ্‌ধৃত করা গেছে। পোলিটিকাল প্রয়োজনে ন্যায়বিচারকেও বিকারপ্রাপ্ত হইতে হয়, পায়োনিয়র তাহা একপ্রকারে স্বীকার করিয়াছেন। জজ বার্কিট সোমেশ্বরের ব্যবহারকে audacity অর্থাৎ দুঃসাহস বলিয়াছেন। স্বত্বরক্ষার উপলক্ষে ইংরাজকে বাধা দেওয়া যে দুঃসাহস, বিচারকই তাহা দেখাইয়াছেন, এবং এই সাহসিকতার অপরাধে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে কারাদন্ড দিয়া বিচারক যে মানসিক গুণের পরিচয় দিয়াছেন তাহাকে আমরা কোনোমতেই সাহসের কোটায় ফেলিতে পারি না। বস্তুত তিনি অবান্তর কারণে সোমেশ্বরের প্রতি অপক্ষপাত ন্যায্য বিচার করিতে সাহসই করেন নাই। এ স্থলে দণ্ডিত যদি audacious হয় তবে দণ্ডদাতার প্রতি ইংরাজি কোন্‌ বিশেষণ প্রয়োগ করা যাইতৈ পারে।

কিন্তু এইরূপ বিচারের ফলাফলকে আমরা তুচ্ছ বলিয়া সাপ্তাহিক পত্রের এক প্যারাগ্রাফের মধ্যে তাহার সমাধি দিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারি না। আমরা প্রতিদিন নানা দৃষ্টান্তের দ্বারা শিখিতেছি যে, পোলিটিকাল প্রয়োজনের যে বিধান, তাহা ন্যায়ের বিধান সত্যের বিধানের সঙ্গে ঠিক মেলে না।

ইহাতে আমাদের শিক্ষাদাতাদের ইষ্ট বা অনিষ্ট কী হইতেছে তাহা লইয়া দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইবার প্রয়োজন দেখি না। ভয়ের কারণ এই যে, আমাদের মন হইতে ধ্রুবধর্মে বিশ্বাস শিথিল, সত্যের আদর্শ বিকৃত হইয়া যাইতেছে। আমরাও প্রয়োজনকে সকলের উচ্চে স্থান দিতে উদ্যত হইয়াছি। আমরাও বুঝিতেছি, পোলিটিকাল উদ্দেশ্যসাধনে ধর্মবুদ্ধিতে দ্বিধা অনুভব করা অনাবশ্যক। অপমানের দ্বারা যে শিক্ষা অস্থিমজ্জার মধ্যে প্রবেশ করে সে শিক্ষার হাত হইতে নিজেকে রক্ষা করিব কী করিয়া? ধর্মকে যদি অকর্মণ্য বলিয়া ঠেলিয়া রাখিতে আরম্ভ করি তবে কিসের উপর নির্ভর করিব? বিলাতি সভ্যতার আদর্শের উপর? বিশ্বজগতের মধ্যে সভ্যতাটাই কি সর্বাপেক্ষা স্থায়ী? দুর্ভাগ্যক্রমে, যে জিনিসটা প্রত্যক্ষভাবে আমাদের বুকের উপরে চাপিয়া বসে সেটা আমাদের পক্ষে পৃথিবীর সব চেয়ে ভারী- আমাদের পক্ষে হিমালয়পর্বতও তাহার চেয়ে লঘু। সেই হিসাবে বিলাতি সভ্যতার নীতিই আমাদের পক্ষে সব চেয়ে গৌরবান্বিত- তাহার কাছে ধর্মনীতি লাগে না।

অতএব ইচ্ছা করি আর না করি বিলাত আমাদিগকে ঠেসিয়া ধরিয়া যে-সকল শিক্ষা দিতেছে তাহা গলাধঃকরণ করিতেই হইবে। আমরা ক্লাইভ্‌কে হেস্টিংস্‌কে ড্যালহৌসিকে আদর্শ নরোত্তম বলিয়াই স্বীকার করিব, ইংরেজের সহিত ন্যায্য-অন্যায্য সর্বপ্রকার সংঘাত-সংঘর্ষ-স্থলে আমরা ন্যায়বিচারের ৫||৪৯ প্রত্যাশাই করিব না, যেখানে ভারতশাসনের প্রয়োজনবশত প্রেস্টিজের দোহাই পড়িবে সেখানে বিশ্ববিধাতার দোহাই মানিব না ইহাই ঘাড় পাতিয়া লইলাম— কিন্তু এই গুরুই যখন শিবাজির রাষ্ট্রনীতিকে অধর্ম বলিয়া আমাদের নিকট নীতিপ্রচার করিতে আসিবেন তখন আমরা কী করিব? তখনো কি ইহাই বুঝিব যে, ধর্মনীতিশাস্ত্রও বর্তমান ক্ষমতাশালীকেই ভয় করিয়া নিজের রায় লিখিয়া থাকেন, অতএব ধিক্‌ শিবাজি!