Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://xn--u5bxfcqewdax4kraj7ob.xn--45brj9c)


পরিশিষ্ট-৪৪
পরিশিষ্ট

এক, ইস্কুলে ছেলেদের মধ্যে যেটুকু বীররসের অবসর আছে, কর্তৃপক্ষ তাহা সহজে প্রশ্রয় দিতে চান না। তাঁরা কেবলই বলেন, আমাদের ছাত্রদিগকে যথেষ্ট শাসনে রাখা হয় না। তাঁহাদের স্বদেশে ছাত্রেরা যে ভাবে মানুষ হয় এ দেশের ছাত্রদের ব্যবহারে তাহার আভাসমাত্রও তাঁহারা সহ্য করিতে পারেন না। যাহা দলন করিতে হইবে তাহা অঙ্কুরেই দলন করা ভালো, এ কথা ইংরাজ জানে। একটা দৃষ্টান্ত দিই। কোনো কলেজের ছাত্র ফুটবল খেলিতে খেলিতে আহত হইয়াছিল। তাহার সঙ্গীরা শুশ্রূষার প্রয়োজনে কাছের একটি সরোবর হইতে কাপড়ে ভিজাইয়া জল লইয়াছিল। সেই সরোবর সাহেবদের পানীয় জলের জন্য সুরক্ষিত ছিল। সেখানে ছাত্রকে নাবিতে দেখিয়া পাহারাওয়ালা নিষেধ করে। সেই উপলক্ষে উভয়পক্ষে বচসা, এমন-কি, হাতাহাতিও হইয়া থাকিবে। ম্যাজিষ্ট্রেট সেই ছাত্রকয়টিকে লইয়া দীর্ঘকাল তাঁহার ডিস্ট্রিক্টের যত দুর্গম স্থানে যে কৌশলে ঘুরাইয়া মারিয়া অবশেষে জরিমানা করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছিলেন, তাহা সেই ছাত্রগণ ও তাহাদের অভিভাবকেরা কোনো কালে ভুলিতে পারিবে না। বাল্যলীলার এরূপ দণ্ডবিধি ইংরাজের নিজের দেশে যে নাই সে কথা সকলেই জানেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো বিদ্যালয়েও, দেশীয় প্রিন্সিপালের বিচারেও, ছাত্রদিগকে যে-সকল লঘুপাপে গুরুদণ্ড সহ্য করিতে হয় তাহাতে তাহাদের পৌরুষচর্চা হয় না।

এই তো গেল ঘরে এবং বিদ্যালয়ে। তাহার পরেও যদি ইংরাজ-অন্যায়কারীর গায়ে ঘুষি তুলিবার মতো স্ফূর্তি কাহারও থাকে, তবে বিচারালয় আছে। দেশীয়দের বিরুদ্ধাচারী ইংরাজ-ক্রিমিনালের প্রতি ইংরাজ-বিচারকের মানবস্বভাবসংগত পক্ষপাত সম্পাদকমহাশয় স্বীকার করেন— সেই স্বাভাবিক পক্ষপাত দেশীয় অপরাধীর পক্ষে কী আকার ধারণ করিতে পারে তাহা অনুমান করা কঠিন নহে। একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমান যুবা গড়ের মাঠে গাড়ি হইতে অন্য গাড়ির একজন ইংরাজকে চাবুক মারিয়া জেলে গিয়াছিল মনে আছে, এলাহাবাদের সোমেশ্বর দাসের কথাও আমরা ভুলিতে পারি না। ইংরাজের গায়ে হাত দিতে গিয়া গ্রামসুদ্ধ দোষী-নির্দোষী বহুতর লোকের কিরুপ অসহ্য লাঞ্ছনা ঘটে, তাহার দৃষ্টান্ত আছে। তাহার কারন, এ দেশে পোলিটিকাল নীতিতে অন্য নীতিকে জটিল করিয়া ফেলে। এ দেশে ইংরাজকে মারার মধ্যে ব্যক্তিগত মার এবং পোলিটিকাল মার, দু'ই আছে— ইস্কুলের ছেলের তুচ্ছ ক্রীড়ার মধ্যে ভাবীকালের পোলিটিকাল সংকটের বীজ প্রচ্ছন্ন আছে— সুতরাং আমাদের ব্যক্তিগত অপমানের প্রতিকার করিতে গিয়া আমরা হঠাৎ পোলিটিকালের মধ্যে পা দিয়া ফেলি, তখন সহসা কাঁধের উপরে যে দণ্ডটা আসিয়া পড়ে তাহার সম্পূর্ণ তাৎপর্য বুঝিতে আমাদের কিছু বিলম্ব হয়। দেশীয়ের প্রতি উপদ্রব করিয়া ইংরাজ অল্প দণ্ড ও ইংরাজের গায়ে হাত দিয়া আমরা গুরু দণ্ড পাই, ইহার মধ্যে শুধু যে মনুষ্যধর্ম আছে তাহা নহে— তাহার সঙ্গে রাজধর্মও যোগ দিয়াছে। এ স্থলে ঘুষি তোলা কম কথা নহে।

মনুষ্যস্বভাবে সাহসের একটা সীমা আছে। জাহাজের একজন কাপ্তেন হাজার অন্যায়কারী হইলেও তাহার অধীনস্থ য়ুরোপীয় নাবিকদল সংখ্যাধিক্যসত্ত্বেও সকলপ্রকার অপমান ও দৌরাত্ম্য অগত্যা সহ্য করিয়াছে, এরূপ ঘটনার কথা অনেক শুনা গিয়াছে। আইনের শাসনকে উপেক্ষা করা শক্ত। জস্টিস হিল ইংরাজ-ক্রিমিনালকে উপদেশ দিবার প্রসঙ্গক্রমে বলিয়াছেন, 'তোমার স্বদেশীয় ভৃত্য তোমার এরূপ ব্যবহার সহ্য করিত না।' না করিবার কারণ আছে। বিচারের চক্ষে স্বদেশীয় ভৃত্য ও স্বদেশীয় মনিব সম্পূর্ণ সমান। সে স্থলে মনিবের দুর্ব্যবহার সহ্য না করিবার প্রভূত বল ভৃত্যের আছে। সে বল ভৃত্যের একলার বল নহে, তাহা তাহার সমস্ত স্বজাতির বল। এই বিপুল বলের সহিত একজন দেশীয় ভৃত্যের একলার বলের তুলনা করা ঠিক নহে।

এখানেও একান্নবর্তী পরিবারের কথা পাড়িতে হয়। একজন ইংরাজের উপর অল্প লোকেরই নির্ভর— আমরা প্রত্যেকেই বহুতর আত্মীয়ের সহিত নানা সম্বন্ধে আবদ্ধ। সেই-সকল সম্বন্ধ আমাদিগকে ত্যাগপরতা সংযম মঙ্গলনিষ্ঠা প্রভৃতি মনুষ্যত্বের উচ্চতর গুণে ভূষিত করিয়াছে— সেই-সকল সম্বন্ধই হিন্দুজাতিকে রিফাইন্‌ড্ ও অকৃত্রিম পাশবিকতা হইতে দূরে রাখিয়াছে— আমাদের পক্ষে হঠকারিতা সহজ হইতেই পারে না, আমাদিগকে জেলের দিকে আকর্ষণ করিলে অনেকগুলা শিকড়েই সাংঘাতিক টান পড়ে। অতএব আমাদের জীর্ণ প্লীহা ইংরাজের বুটাগ্রের পক্ষে যেরূপ সহজ লক্ষ্য, ইংরাজের নাসাগ্র আমাদের বদ্ধমুষ্টির পক্ষে সেরূপ সুন্দর সুগম নহে।