
দেখো, এই একটি সামান্য ঘটনায় ইংলিশ্ম্যান কম্পান্বিত। অন্যায় করিবার অপ্রতিহত ক্ষমতা যদি কোনো উপায়ে একটু খর্ব হয়, তবে কী আতঙ্কের বিষয়! ইহা হইতে এই প্রমাণ হয় যে, এ দেশে ইংরাজ অবিচারের বলেই আপনাকে বলী মনে করে। সেই বলের পশ্চাতে নিরাপদে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া তাহারা অত্যাচার করিবার সহজ স্বত্বকে চিরস্থায়ী করিতে চাহে। করিতে পারে করুক— কিন্তু ইহার পরে ভীরুতার অপবাদ আমাদিগকে দেওযা আর চলে না।
ইংরাজ ও ভারতবর্ষীয়ের মধ্যে অপক্ষপাত বিচারে ‘কঙ্করর’ ও ‘রূলর’ -দের যে প্রেস্টিজের হানি হয়, এ আশঙ্কা এ দেশের সাধারণ ইংরাজের মনে জাগিয়া আছে— জজ এবং জুরি নিতান্ত অসাধারণ না হইলে ইহার ব্যতিক্রম হয় না। অপক্ষপাতে সুবিচার করিতে যাহারা ভয় করে, তাহারা এক দিকে আমাদের পক্ষে ভয়ানক, তেমনি আর-এক দিকে তাহাদের এই ভীরুতাই আমাদের কাছে তাহাদের দুর্বলতা প্রতিপন্ন করে। আমাদের কাছে ইহাতে তাহাদের মর্যাদা কমিয়া গেছে। এখন আমরা ইংরাজকে ঘরে-ঘরে এবং মনে-মনে খাটো করিতেছি। পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি অন্ধভক্তি এক সময়ে আমাদিগকে যেরূপ সম্পূর্ণ অভিভূত করিয়া দিয়াছিল এখন আমরা ক্রমশই তাহা হইতে মুক্তিলাভ করিতেছি। আমাদের দেশের চিরন্তন ধর্মনীতির যে আদর্শ তাহা প্রত্যহ আমাদের কাছে উজ্জ্বলতর হইয়া আসিতেছে। আমরা পাশ্চাত্য বর্বরতার নগ্নমূর্তি যতই দেখিতেছি ততই আশ্রয়লাভের জন্য আমাদের স্বদেশীয় কুলায়ের মধ্যেই একে একে ফিরিয়া আসিবার উপক্রম করিতেছি। এইরূপে আমাদের অপমানের মধ্য দিয়াও আত্মসম্মানের পথ কিরূপে উদ্ঘাটিত হইয়াছে, আমার প্রবন্ধে তাহার আভাস ছিল।
আর-একটি কথা ছিল, বোধ হয ‘নিয়ু ইন্ডিয়া’-সম্পাদকমহাশয় সেইটেতেই আপত্তি করিয়াছেন। আমি বলিয়াছিলাম, আমাদের দেশে একান্নবর্তী পরিবার প্রথা এমন যে, বাল্যকাল হইতে আমাদিগকে সর্বপ্রকারে বিরোধের অপেক্ষা মিলনের জন্যই প্রস্তুত করে। আমাদিগকে আত্মত্যাগ এবং ধৈর্যই শিক্ষা দিতে থাকে। আমরা যদি ক্ষমায় দীক্ষিত না হই, তবে এতগুলি লোকের একত্রে থাকা অসম্ভব হয়। অতএব আমরা যে খপ্ করিয়া কাহারও নাক-চোখের উপর ঘুষি মারিতে, বা ভূপতিত ব্যক্তির মুখের উপর বা রাগ করিয়া কাহারও তলপেটে উপর্যুপরি লাথি মারিতে পারি না, তাহার কারণ আমাদের সাহসের অভাব নহে— তাহার প্রধান কারণ, আমাদের দেশের সামাজিক আদর্শে আমাদিগকে নিরীহ করিয়াছে। ইংরাজ কথঞ্চিৎ পরিহাসের ভঙ্গিতে আমাদিগকে ‘mild Hindu’ বলিয়া থাকে— বস্তুতই আমরা মাইল্ড্ হিন্দু। ইহাতে আমাদের অসুবিধা ঘটিতেছে তাহা দেখিতেছি, এবং এখন বর্তমান অবস্থায় কী করা কর্তব্য তাহাও বিচার্য— কিন্তু মাইল্ড্ বলিয়া আমাদের লজ্জায় ঘাড় হেঁট করিবার কথা নহে। ভারতবাসী মৃত্যুকে ভয় করে বলিয়া যে কাহাকেও আক্রমণ করে না তাহা নহে— বোয়ার-যুদ্ধে ভারতবর্ষীয় ডুলিবাহকেরাও দেখাইয়াছে যে, তাহারা বিনা উত্তেজনাতেও অবিচলিতভাবে মৃত্যুর মুখের সম্মুখে আপনার কাজ করিয়া যাইতে পারে১— কিন্তু তাহার ধর্ম, তাহার সমাজ তাহার হিংস্রপ্রবৃত্তি লোপ করিয়া দিয়াছে— এতদুর করিয়াছে যে, তাহাতে তাহার স্বার্থহানি ও অসুবিধা ঘটে এবং তাহার মানহানি ঘঢিতেছে। এই নিরীহতাকে যদি তিরস্কার করিতে হয়, তবে ভীরুতাকে যে ভাষায় করিবে, ইহাকেও কি সেই ভাষায় করিবে?
১ স্যাভেজ ল্যান্ডর -নামক ভ্রমণকারী যখন তিব্বতভ্রমণে গিয়াছিলেন তখন তাঁহার সমুদয় ভৃত্যই প্রাণভয়ে তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করে, কেবল চন্দনসিং ও মানসিং বলিয়া তাঁহার যে দুটিমাত্র হিন্দুভৃত্য ছিল তাহারা কখনো পলায়নের চেষ্টামাত্রও করে নাই— তাহারা আসন্নমৃত্যুর শঙ্কায় এবং অসহ্য উৎপীড়নেও অবিচলিত থাকে— অথচ নূতন দেশ-আবিষ্কারের উত্তেজনা, সমাজে যশের প্রত্যাশা বা ভ্রমণবৃত্তান্ত ছাপাইয়া অর্থলাভের প্রলোভন, তাহাদের কিছূই ছিল না। তাহাদের প্রভুও বিদেশী এবং অল্পদিনের— কিন্তু তাহারা হিন্দু, অন্যকে মারিবার জন্য তাহারা সর্বদাই উদ্যত নয়, অথচ মরিতে ভয় করে না।