হিন্দু-মুসলমান এক হইলে পরস্পরের কত সুবিধা একদিন কোনো সভায় মুসলমান শ্রোতাদিগকে তাহাই বুঝাইয়া বলা হইতেছিল। তখন আমি এই কথাটি না বলিয়া থাকিতে পারি নাই যে, সুবিধার কথাটা এ স্থলে মুখে আনিবার নহে; দুই ভাই এক হইয়া থাকিলে বিষয়কর্ম ভালো চলে, কিন্তু সেইটেই দুই ভাই এক থাকিবার প্রধান হেতু হওয়া উচিত নহে। কারণ, ঘটনাক্রমে সুবিধার গতি পরিবর্তন হওয়াও আশ্চর্যকর নহে। আসল কথা, আমরা এক দেশে এক সুখদুঃখের মধ্যে একত্রে বাস করি, আমরা মানুষ, আমরা যদি এক না হই তবে সে লজ্জা,সে অধর্ম। আমরা উভয়েই এক দেশের সন্তান– আমরা ঈশ্বরকৃত সেই ধর্মের বন্ধনবশত, শুধু সুবিধা নহে, অসুবিধাও একত্রে ভোগ করিতে প্রস্তুত যদি না হই তবে আমাদের মনুষ্যত্বে ধিক্। আমাদের পরস্পরের মধ্যে, সুবিধার চর্চা নহে, প্রেমের চর্চা, নিঃস্বার্থ সেবার চর্চা যদি করি তবে সুবিধা উপস্থিত হইলে তাহা পুরা প্রহণ করিতে পারিব এবং অসুবিধা উপস্থিত হইলেও তাহাকে বুক দিয়া ঠেকাইতে পারিব।
এইজন্য অদ্যকার অত্যন্ত উত্তেজনার দিনেও আমাকে এ কথা বলিতে হইতেছে যে, স্পর্ধা করিবার, লড়াই করিবার দিন আজ আমাদের নহে। স্পর্ধা করাটা শক্তিমানের পক্ষে একটা বিলাসের স্বরূপ হইতে পারে, কিন্তু অশক্তের পক্ষে তাহা দেউলে হইবার পন্থা। যে শক্তি তাহাতে অপব্যয় হয় তাহা খরচ করিবার সম্বল আমাদের আছে কি। শুধু তাই নয়, যে হিসাবের উপর নির্ভর করিয়া আমরা এতটা আস্ফালন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, সে হিসাবটা কি ভালোরূপ পরীক্ষা করিয়া দেখা হইয়াছে। যে নৌকায় কোনোমতে ভর সয় মাত্র সে নৌকায় নৃত্য করিতে শুরু করিলে যদি তাহার ফাটগুলা দিয়া জল উঠিতে থাকে তবে সেটাকে আমরা এমন অভাবনীয় বলিয়া মনে করি কেন। এই নৃত্যব্যাপারে আমি আপত্তি করিতে চাই না কিন্তু ইহাই যদি আমাদের অভিপ্রায় থাকে তবে একটু সবুর করিয়া অন্তত ঐ ফাটাগুলা সারাইয়া লইতে হইবে তো?— তাহাতে বিলম্ব হইবে। তা হইবে বটে, কিন্তু জগতের মধ্যে আমরা এমন পুণ্য করি নাই যে, ভাঙা আসবাব লইয়া কাজও করিব, দুর্লভ ধন লাভও করিব, অথচ বিলম্বও ঘটিবে না।
তবে করিতে হইবে কী। আর-কিছু নয়, স্বদেশ সম্বন্ধে স্বদেশীর যে দায়িত্ব আছে তাহা সর্বসাধারণের কাছে স্পষ্টরূপে প্রত্যক্ষ করিয়া তুলিতে হইবে। পুরাতন দলই হউন আর নূতন দলই হউন, যিনি পারেন একটা কাজের আয়োজন করুন। প্রমাণ করুন যে, দেশের ভার তাঁহারা লইতে পারেন। তাঁহাদের মত কী সে তো বারংবার শুনিয়াছি, তাঁহাদের কাজ কী কেবল সেইটেই দেখা হইল না। দেশের সমস্ত সামর্থ্যকে একত্রে টানিয়া যদি তাহাকে একটা কলেবর দান করিতে না পারি, যদি সেইখান হইতে স্বচেষ্টায় দেশের অন্ন বস্ত্র স্বাস্থ্য ও শিক্ষার একটা সুবিহিত ব্যবস্থা করিয়া তোলা আমাদের সকল দলের পক্ষেই অসম্ভব হয়, যদি আমাদের কোনোপ্রকার কর্মনীতি ও কর্মসংকল্প না থাকে, তবে আজিকার এই আস্ফালন কাল আমাদিগকে নিষ্ফল অবসাদের মধ্যে ধাক্কা দিয়া ফেলিয়া দিবে।
যদি সকলে মিলিয়া একটা কাজের আয়োজন গড়িয়া তুলিবার শক্তি আজও আমাদের না হইয়া থাকে তবে অগত্যা আমাদিগকে নিভৃতে নিঃশব্দে ব্যক্তিগত চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইতে হইবে। কিন্তু যদি আমরা অসময়ে ঔদ্ধত্য করিতে থাকি সেই বিচ্ছিন্ন চেষ্টার ক্ষেত্র একেবারে নষ্ট হয়। গর্ভিণীকে সমস্ত অপঘাত হইতে নিজেকে বাঁচাইয়া সাবধানে চলিতে হয়— সেই সতর্কতা ভীরুতা নহে, তাহা তাহার কর্তব্য।