রাজা। ভয় নেই, তোমার ভয় নেই। আগুন এ ঘরে এসে পৌঁছবে না।
সুদর্শনা। ভয় আমার নেই— কিন্তু লজ্জা! লজ্জা যে আগুনের মতো আমার সঙ্গে সঙ্গে এসেছে। আমার মুখ-চোখ, আমার সমস্ত হৃদয়টাকে রাঙা করে রেখেছে।
রাজা। এ দাহ মিটতে সময় লাগবে।
সুদর্শনা। কোনোদিন মিটবে না, কোনোদিন মিটবে না।
রাজা। হতাশ হোয়ো না রানী।
সুদর্শনা। তোমার কাছে মিথ্যা বলব না রাজা— আমি আর-এক জনের মালা গলায় পরেছি।
রাজা। ও মালাও যে আমার, নইলে সে পাবে কোথা থেকে। সে আমার ঘর থেকে চুরি করে এনেছে।
সুদর্শনা। কিন্তু এ যে তারই হাতের দেওয়া। তবু তো ত্যাগ করতে পারলুম না। যখন চার দিকে আগুন আমার কাছে এগিয়ে এল তখন একবার মনে করলুম, এই মালাটা আগুনে ফেলে দিই। কিন্তু পারলুম না। আমার পাপিষ্ঠ মন বললে, ঐ হার গলায় নিয়ে পুড়ে মরব। আমি তোমাকে বাইরে দেখব বলে পতঙ্গের মতো এ কোন্ আগুনে ঝাঁপ দিলুম। আমিও মরি নে, আগুনও নেবে না, এ কী জ্বালা!
রাজা। তোমার সাধ তো মিটেছে, আমাকে তো আজ দেখে নিলে।
সুদর্শনা। আমি কি তোমাকে এমন সর্বনাশের মধ্যে দেখতে চেয়েছিলুম! কী দেখলুম জানি নে, কিন্তু বুকের মধ্যে এখনো কাঁপছে।
রাজা। কেমন দেখলে রানী।
সুদর্শনা। ভয়ানক, সে ভয়ানক। সে আমার স্মরণ করতেও ভয় হয়। কালো, কালো, তুমি কালো। আমি কেবল মুহূর্তের জন্যে চেয়েছিলুম। তোমার মুখের উপর আগুনের আভা লেগেছিল— আমার মনে হল, ধূমকেতু যে আকাশে উঠেছে সেই আকাশের মতো তুমি কালো। তখনই চোখ বুজে ফেললুম, আর চাইতে পারলুম না— ঝড়ের মেঘের মতো কালো, কূলশূন্য সমুদ্রের মতো কালো— তারই তুফানের উপরে সন্ধ্যার রক্তিমা।
রাজা। আমি তো তোমাকে পূর্বেই বলেছি, যে লোক আগে থাকতে প্রস্তুত না হয়েছে সে যখন আমাকে হঠাৎ দেখে সইতে পারে না; আমাকে বিপদ বলে মনে ক’রে আমার কাছ থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে চায়। এমন কতবার দেখেছি। সেইজন্যে সেই দুঃখ থেকে বাঁচিয়ে ক্রমে ক্রমে তোমার কাছে পরিচয় দিতে চেয়েছিলুম।
সদুর্শনা। কিন্তু পাপ এসে সমস্ত ভেঙে দিলে— এখন আর যে তোমার সঙ্গে তেমন করে পরিচয় হতে পারবে তা মনে করতেও পারি নে।
রাজা। হবে রানী, হবে। যে কালো দেখে আজ তোমার বুক কঁপে গেছে সেই কালোতেই একদিন তোমার হৃদয় স্নিগ্ধ হয়ে যাবে। নইলে আমার ভালোবাসা কিসের।