বিনয়। আমার নাম বিনয়ভূষণ চট্টোপাধ্যায়।
বৃদ্ধ কহিলেন, “আমার নাম পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য। নিকটেই ৭৮ নম্বর বাড়িতে থাকি। কখনো অবকাশমত যদি আমাদের ওখানে যান তো বড়ো খুশি হব।”
মেয়েটি বিনয়ের মুখের দিকে দুই চোখ তুলিয়া নীরবে এই অনুরোধের সমর্থন করিল। বিনয় তখনই সেই গাড়িতে উঠিয়া তাঁহাদের বাড়িতে যাইতে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু সেটা ঠিক শিষ্টাচার হইবে কি না ভাবিয়া না পাইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। গাড়ি ছাড়িবার সময় মেয়েটি বিনয়কে ছোটো একটি নমস্কার করিল। এই নমস্কারের জন্য বিনয় একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, এইজন্য হতবুদ্ধি হইয়া সে প্রতিনমস্কার করিতে পারিল না। এইটুকু ত্রুটি লইয়া বাড়িতে ফিরিয়া সে নিজেকে বার বার ধিক্কার দিতে লাগিল। ইঁহাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইতে বিদায় হওয়া পর্যন্ত বিনয় নিজের আচরণ সমস্তটা আলোচনা করিয়া দেখিল; মনে হইল, আগাগোড়া তাহার সমস্ত ব্যবহারেই অসভ্যতা প্রকাশ পাইয়াছে। কোন্ কোন্ সময়ে কী করা উচিত ছিল, কী বলা উচিত ছিল, তাহা লইয়া মনে মনে কেবলই বৃথা আন্দোলন করিতে লাগিল। ঘরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, যে রুমাল দিয়া মেয়েটি তাহার বাপের মুখ মুছাইয়া দিয়াছিল সেই রুমালটি বিছানার উপর পড়িয়া আছে— সেটা তাড়াতাড়ি তুলিয়া লইল। তাহার মনের মধ্যে বাউলের সুরে ঐ গানটা বাজিতে লাগিল—
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়।
বেলা বাড়িয়া চলিল, বর্ষার রৌদ্র প্রখর হইয়া উঠিল, গাড়ির স্রোত আপিসের দিকে বেগে ছুটিতে লাগিল, বিনয় তাহার দিনের কোনো কাজেই মন দিতে পারিল না। এমন অপূর্ব আনন্দের সঙ্গে এমন নিবিড় বেদনা তাহার বয়সে কখনো সে ভোগ করে নাই। তাহার এই ক্ষুদ্র বাসা এবং চারি দিকের কুৎসিত কলিকাতা মায়াপুরীর মতো হইয়া উঠিল; যে রাজ্যে অসম্ভব সম্ভব হয়, অসাধ্য সিদ্ধ হয় এবং অপরূপ রূপ লইয়া দেখা দেয়, বিনয় যেন সেই নিয়ম-ছাড়া রাজ্যে ফিরিতেছে। এই বর্ষাপ্রভাতের রৌদ্রের দীপ্ত আভা তাহার মস্তিষ্কের মধ্যে প্রবেশ করিল, তাহার রক্তের মধ্যে প্রবাহিত হইল, তাহার অন্তঃকরণের সম্মুখে একটা জ্যোতির্ময় যবনিকার মতো পড়িয়া প্রতিদিনের জীবনের সমস্ত তুচ্ছতাকে একেবারে আড়াল করিয়া দিল। বিনয়ের ইচ্ছা করিতে লাগিল নিজের পরিপূর্ণতাকে আশ্চর্যরূপে প্রকাশ করিয়া দেয়, কিন্তু তাহার কোনো উপায় না পাইয়া তাহার চিত্ত পীড়িত হইতে লাগিল। অত্যন্ত সামান্য লোকের মতোই সে আপনার পরিচয় দিয়াছে— তাহার বাসাটা অত্যন্ত তুচ্ছ, জিনিসপত্র নিতান্ত এলোমেলো, বিছানাটা পরিষ্কার নয়, কোনো-কোনো দিন তাহার ঘরে সে ফুলের তোড়া সাজাইয়া রাখে, কিন্তু এমনি দুর্ভাগ্য— সেদিন তাহার ঘরে একটা ফুলের পাপড়িও ছিল না। সকলেই বলে বিনয় সভাস্থলে মুখে মুখে যেরূপ সুন্দর বক্তৃতা করিতে পারে কালে সে একজন মস্ত বক্তা হইয়া উঠিবে, কিন্তু সেদিন সে এমন একটা কথাও বলে নাই যাহাতে তাহার বুদ্ধির কিছুমাত্র প্রমাণ হয়। তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল, ‘যদি এমন হইতে পারিত যে সেই বড়ো গাড়িটা যখন তাঁহাদের গাড়ির উপর আসিয়া পড়িবার উপক্রম করিতেছে আমি বিদ্যুদ্বেগে রাস্তার মাঝখানে আসিয়া অতি অনায়াসে সেই উদ্দাম জুড়িঘোড়ার লাগাম ধরিয়া থামাইয়া দিতাম!’ নিজের সেই কাল্পনিক বিক্রমের ছবি যখন তাহার মনের মধ্যে জাগ্রত হইয়া উঠিল তখন একবার আয়নায় নিজের চেহারা না দেখিয়া থাকিতে পারিল না।
এমন সময় দেখিল একটি সাত-আট বছরের ছেলে রাস্তায় দাঁড়াইয়া তাহার বাড়ির নম্বর দেখিতেছে। বিনয় উপর হইতে বলিল, “এই-যে, এই বাড়িই বটে।” ছেলেটি যে তাহারই বাড়ির নম্বর খুঁজিতেছিল সে সম্বন্ধে তাহার মনে সন্দেহমাত্র হয় নাই। তাড়াতাড়ি বিনয় সিঁড়ির উপর চটিজুতা চট্ চট্ করিতে করিতে নীচে নামিয়া গেল— অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে ছেলেটিকে ঘরের মধ্যে লইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিল।
সে কহিল, “দিদি আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে।”