এই বলিয়া বিনয়ভূষণের হাতে এক পত্র দিল।
বিনয় চিঠিখানা লইয়া প্রথমে লেফাফার উপরটাতে দেখিল, পরিষ্কার মেয়েলি ছাঁদের ইংরেজি অক্ষরে তাহার নাম লেখা। ভিতরে চিঠিপত্র কিছুই নাই, কেবলই কয়েকটি টাকা আছে।
ছেলেটি চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেই বিনয় তাহাকে কোনোমতেই ছাড়িয়া দিল না। তাহার গলা ধরিয়া তাহাকে দোতলার ঘরে লইয়া গেল।
ছেলেটির রঙ তাহার দিদির চেয়ে কালো, কিন্তু মুখের ছাঁদে কতকটা সাদৃশ্য আছে। তাহাকে দেখিয়া বিনয়ের মনে ভারি একটা স্নেহ এবং আনন্দ জন্মিল।
ছেলেটি বেশ সপ্রতিভ। সে ঘরে ঢুকিয়া দেয়ালে একটা ছবি দেখিয়াই জিজ্ঞাসা করিল, “এ কার ছবি?”
বিনয় কহিল, “এ আমার একজন বন্ধুর ছবি।”
ছেলেটি জিজ্ঞাসা করিল, “বন্ধুর ছবি? আপনার বন্ধু কে?”
বিনয় হাসিয়া কহিল, “তুমি তাঁকে চিনবে না। আমার বন্ধু গৌরমোহন, তাঁকে গোরা বলি। আমরা ছেলেবেলা থেকে একসঙ্গে পড়েছি।”
“এখনো পড়েন?”
“না, এখন আর পড়ি নে।”
“আপনার স—ব পড়া হয়ে গেছে?”
বিনয় এই ছোটো ছেলেটির কাছেও গর্ব করিবার প্রলোভন সংবরণ করিতে না পারিয়া কহিল, “হাঁ সব পড়া হয়ে গেছে।”
ছেলেটি বিস্মিত হইয়া একটু নিশ্বাস ফেলিল। সে বোধ হয় ভাবিল, এত বিদ্যা সেও কত দিনে শেষ করিতে পারিবে।
বিনয়। তোমার নাম কী?
“আমার নাম শ্রীসতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।”
বিনয় বিস্মিত হইয়া কহিল, “মুখোপাধ্যায়?”
তাহার পরে একটু একটু করিয়া পরিচয় পাওয়া গেল। পরেশবাবু ইহাদের পিতা নহেন— তিনি ইহাদের দুই ভাইবোনকে ছেলেবেলা হইতে পালন করিয়াছেন। ইহার দিদির নাম আগে ছিল রাধারানী— পরেশবাবুর স্ত্রী তাহা পরিবর্তন করিয়া ‘সুচরিতা’ নাম রাখিয়াছেন।
দেখিতে দেখিতে বিনয়ের সঙ্গে সতীশের খুব ভাব হইয়া গেল। সতীশ যখন বাড়ি যাইতে উদ্যত হইল বিনয় কহিল, “তুমি একলা যেতে পারবে?”
সে গর্ব করিয়া কহিল, “আমি তো একলা যাই!”
বিনয় কহিল, “আমি তোমাকে পৌঁছে দিই গে।”
তাহার শক্তির প্রতি বিনয়ের এই সন্দেহ দেখিয়া সতীশ ক্ষুব্ধ হইয়া কহিল, “কেন, আমি তো একলা যেতে পারি।” এই বলিয়া তাহার একলা যাতায়াতের অনেকগুলি বিস্ময়কর দৃষ্টান্তের সে উল্লেখ করিতে লাগিল। কিন্তু তবু যে বিনয় কেন তাহার বাড়ির দ্বার পর্যন্ত তাহার সঙ্গে গেল তাহার ঠিক কারণটি বালক বুঝিতে পারিল না।
সতীশ জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি ভিতরে আসবেন না?”
বিনয় সমস্ত মনকে দমন করিয়া কহিল, “আর-এক দিন আসব।”