বিনয় হাসিয়া উঠিল, কহিল, “ডাক্তার আশা ছেড়ে দিলেই যে রোগী সব সময়ে মরে তা নয়। আমি তো নিদেন-কালের লক্ষণ বুঝতে পারছি নে।”
গোরা। পারছ না?
বিনয়। না।
গোরা। নাড়ী ছাড়ে-ছাড়ে করছে না?
বিনয়। না, দিব্যি জোর আছে।
গোরা। মনে হচ্ছে না যে, শ্রীহস্তে যদি পরিবেশন করে তবে ম্লেচ্ছের অন্নই দেবতার ভোগ?
বিনয় অত্যন্ত সংকুচিত হইয়া উঠিল, কহিল, “গোরা, বস্, এইবার থামো।”
গোরা। কেন, এর মধ্যে তো আবরুর কোনো কথা নেই। শ্রীহস্ত তো অসূর্যম্পশ্য নয়। পুরুষমানুষের সঙ্গে যার শেক্হ্যাণ্ড চলে সেই পবিত্র করপল্লবের উল্লেখটি পর্যন্ত যখন তোমার সহ্য হল না, তদা নাশংসে মরণায় সঞ্জয়!
বিনয়। দেখো গোরা, আমি স্ত্রীজাতিকে ভক্তি করে থাকি— আমাদের শাস্ত্রেও—
গোরা। স্ত্রীজাতিকে যে ভাবে ভক্তি করছ তার জন্যে শাস্ত্রের দোহাই পেড়ো না! ওকে ভক্তি বলে না, যা বলে তা যদি মুখে আনি তো মারতে আসবে।
বিনয়। এ তুমি গায়ের জোরে বলছ।
গোরা। শাস্ত্রে মেয়েদের বলেন ‘পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ’। তাঁরা পুজার্হা, কেননা গৃহকে দীপ্তি দেন। পুরুষমানুষের হৃদয়কে দীপ্ত করে তোলেন বলে বিলিতি বিধানে তাঁদের যে মান দেওয়া হয় তাকে পূজা না বললেই ভালো হয়।
বিনয়। কোনো কোনো স্থলে বিকৃতি দেখা যায় বলে কি একটা বড়ো ভাবের উপর ওরকম কটাক্ষপাত করা উচিত!
গোরা অধীর হইয়া কহিল, “বিনু, এখন যখন তোমার বিচার করবার বুদ্ধি গেছে তখন আমার কথাটা মেনেই নাও। আমি বলছি বিলিতি শাস্ত্রে স্ত্রীজাতি-সম্বন্ধে যে-সমস্ত অত্যুক্তি আছে তার ভিতরকার কথাটা হচ্ছে বাসনা। স্ত্রীজাতিকে পুজো করবার জায়গা হল মা’র ঘর, সতীলক্ষ্মী গৃহিণীর আসন। সেখান থেকে সরিয়ে এনে তাঁদের যে স্তব করা হয়, তার মধ্যে অপমান লুকিয়ে আছে। পতঙ্গের মতো তোমার মনটা যে-কারণে পরেশবাবুর বাড়ির চারি দিকে ঘুরছে, ইংরাজিতে তাকে বলে থাকে ‘লাভ’— কিন্তু ইংরেজের নকল ঐ ‘লাভ’ ব্যাপারটাকেই সংসারের মধ্যে একটা চরম পুরুষার্থ বলে উপাসনা করতে হবে, এমন বাঁদরামি যেন তোমাকে না পেয়ে বসে!”
বিনয় কশাহত তাজা ঘোড়ার মতো লাফাইয়া উঠিয়া কহিল, “আঃ গোরা, থাক্, যথেষ্ট হয়েছে।”
গোরা। কোথায় যথেষ্ট হয়েছে! কিছুই হয় নি। স্ত্রী আর পুরুষকে তাদের স্বস্থানে বেশ সহজ করে দেখতে শিখি নি বলেই আমরা কতকগুলো কবিত্ব জমা করে তুলেছি।
বিনয় কহিল, “আচ্ছা, মানছি স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধ ঠিক যে জায়গাটাতে থাকলে সহজ হতে পারত আমরা প্রবৃত্তির ঝোঁকে সেটা লঙ্ঘন করি এবং সেটাকে মিথ্যে করে তুলি, কিন্তু এই অপরাধটা কি কেবল বিদেশেরই? এ সম্বন্ধে ইংরেজের কবিত্ব যদি মিথ্যে হয় তো আমরা ঐ যে কামিনীকাঞ্চনত্যাগ নিয়ে সর্বদা বাড়াবাড়ি করে থাকি সেটাও তো মিথ্যে। মানুষের প্রকৃতি যা নিয়ে সহজে