![](/themes/rabindra/logo.png)
যে অনাগত মানুষটির উদ্দেশে উঠছে তার আত্মনিবেদনের অর্ঘ্য, সমুখে এসে পৌঁছবার আগেই সে যেন ওর কাছে প্রতিদিন তার পেয়ালা পাঠিয়ে দিয়েছে। বর্ষার রাত্রে খিড়কির বাগানের গাছগুলি অবিশ্রাম ধারাপতনের আঘাতে আপন পল্লবগুলিকে যখন উতরোল করেছে তখন কানাড়ার সুরে মনে পড়েছে তার ঐ গান—
কৈস করো যাউঁ ঘরোয়ারে।
আপন উদাস মনটার পায়ে পায়ে নূপুর বাজছে ঝননন— উদ্দেশহারা পথে বেরিয়ে পড়েছে, কোনোকালে ফিরবে কেমন করে ঘরে! যাকে রূপে দেখবে এমনি করে কতদিন থেকে তাকে সুরে দেখতে পাচ্ছিল। নিগূঢ় আনন্দ-বেদনার পরিপূর্ণতার দিনে যদি মনের মতো কাউকে দৈবাৎ সে কাছে পেত তা হলে অন্তরের সমস্ত গুঞ্জরিত গানগুলি তখনই প্রাণ পেত রূপে। কোনো পথিক ওর দ্বারে এসে দাঁড়াল না। কল্পনার নিভৃত নিকুঞ্জগৃহে ও একেবারেই ছিল একলা। এমন-কি, ওর সমবয়সী সঙ্গিনীও বিশেষ কেউ ছিল না। তাই এতদিন শ্যামসুন্দরের পায়ের কাছে ওর নিরুদ্ধ ভালোবাসা পূজার ফুল-আকারে আপন নিরুদ্দিষ্ট দয়িতের উদ্দেশ খুঁজেছে। সেইজন্যেই ঘটক যখন বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে এল কুমু তখন তার ঠাকুরেরই হুকুম চাইলে— জিজ্ঞাসা করলে, ‘এইবার তোমাকেই তো পাব?’ অপরাজিতার ফুল বললে, ‘এই তো পেয়েইছ।’
অন্তরের এতদিনের এত আয়োজন ব্যর্থ হল— একেবারে ঠন্ করে উঠল পাথরটা, ভরাডুবি হল এক মুহূর্তেই। ব্যথিত যৌবন আজ আবার খুঁজতে বেরিয়েছে, কোথায় দেবে তার ফুল! থালিতে যা ছিল তার অর্ঘ্য, সে যে আজ বিষম বোঝা হয়ে উঠল! তাই আজ এমন করে প্রাণপণে গাইছে, ‘মেরে গিরিধর গোপাল, ঔর নাহি কোহি।’
কিন্তু আজ এ গান শূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পৌঁছোল না কোথাও। এই শূন্যতায় কুমুর মন ভয়ে ভরে উঠল। আজ থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মনের গভীর আকাঙ্ক্ষা কি ঐ ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতোই কেবল সঙ্গীহীন নিঃশ্বসিত হয়ে উঠবে?
মোতির মা দূরে পিছনে বসে রইল। সকালের নির্মল আলোয় নির্জন ছাদে এই অসজ্জিতা সুন্দরীর মহিমা ওকে বিস্মিত করে দিয়েছে। ভাবছে, এ বাড়িতে ওকে কেমন করে মানাবে? এখানে যে-সব মেয়ে আছে এর তুলনায় তারা কোন্ জাতের? তারা আপনি ওর থেকে পৃথক হয়ে পড়েছে, ওর উপরে রাগ করছে কিন্তু ওর সঙ্গে ভাব করতে সাহস করছে না।
বসে থাকতে থাকতে মোতির মা হঠাৎ দেখলে কুমু দুই হাতে তার ওড়নার আঁচল মুখে চেপে ধরে কেঁদে উঠেছে। ও আর থাকতে পারলে না, কাছে এসে গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, “দিদি আমার, লক্ষ্মী আমার, কী হয়েছে বলো আমাকে।”
কুমু অনেকক্ষণ কথা কইতে পারলে না, একটু সামলে নিয়ে বললে, “আজও দাদার চিঠি পেলুম না, কী হয়েছে তাঁর বুঝতে পারছি নে।”
“চিঠি পাবার কি সময় হয়েছে ভাই?”
“নিশ্চয় হয়েছে। আমি তাঁর অসুখ দেখে এসেছি। তিনি জানেন, খবর পাবার জন্যে আমার মনটা কী রকম করছে।”
মোতির মা বললে, “তুমি ভেবো না, খবর নেবার আমি একটা-কিছু উপায় করব।”
কুমু টেলিগ্রাফ করবার কথা অনেকবার ভেবেছে, কিন্তু কাকে দিয়ে করাবে। যেদিন মধুসূদন নিজেকে ওর দাদার মহাজন বলে বড়াই করেছিল সেইদিন থেকে মধুসূদনের কাছে ওর দাদার উল্লেখমাত্র করতে ওর মুখে বেধে যায়। আজ মোতির মাকে বললে, “তুমি যদি দাদাকে আমার নামে টেলিগ্রাফ করতে পার তো আমি বাঁচি।”
মোতির মা বললে, “তাই করব, ভয় কী?”
কুমু বললে, “তুমি জান, আমার কাছে একটিও টাকা নেই।”