সতীশ বিনয়ের হাত ধরিয়া কহিল, “বিনয়বাবু, আপনি যে সেদিন বললেন আমাদের বাড়িতে যাবেন, কই গেলেন না তো?”
বিনয় সস্নেহে সতীশের পিঠে হাত দিয়া হাসিতে লাগিল। পরেশ সাবধানে তাঁহার লাঠিগাছটি টেবিলের গায়ে ঠেস দিয়া দাঁড় করাইয়া চৌকিতে বসিলেন ও কহিলেন, “সেদিন আপনি না থাকলে আমাদের ভারি মুশকিল হত। বড়ো উপকার করেছেন।”
বিনয় ব্যস্ত হইয়া কহিল, “কী বলেন, কীই বা করেছি।”
সতীশ হঠাৎ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা বিনয়বাবু, আপনার কুকুর নেই?”
বিনয় হাসিয়া কহিল, “কুকুর? না, কুকুর নেই।”
সতীশ জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, কুকুর রাখেন নি কেন?”
বিনয় কহিল, “কুকুরের কথাটা কখনো মনে হয় নি।”
পরেশ কহিলেন, “শুনলুম সেদিন সতীশ আপনার এখানে এসেছিল, খুব বোধ হয় বিরক্ত করে গেছে। ও এত বকে যে, ওর দিদি ওকে বক্তিয়ার খিলিজি নাম দিয়েছে।”
বিনয় কহিল, “আমিও খুব বকতে পারি তাই আমাদের দুজনের খুব ভাব হয়ে গেছে। কী বল সতীশবাবু!”
সতীশ এ কথার কোনো উত্তর দিল না; কিন্তু পাছে তাহার নূতন নামকরণ লইয়া বিনয়ের কাছে তাহার গৌরবহানি হয় সেইজন্য সে ব্যস্ত হইয়া উঠিল। এবং কহিল, “বেশ তো, ভালোই তো। বক্তিয়ার খিলিজি ভালোই তো। আচ্ছা বিনয়বাবু, বক্তিয়ার খিলিজি তো লড়াই করেছিল? সে তো বাংলা দেশ জিতে নিয়েছিল?”
বিনয় হাসিয়া কহিল, “আগে সে লড়াই করত, এখন আর লড়াইয়ের দরকার হয় না, এখন সে শুধু বক্তৃতা করে। আর বাংলা দেশ জিতেও নেয়।”
এমনি করিয়া অনেকক্ষণ কথাবার্তা হইল। পরেশ সকলের চেয়ে কম কথা কহিয়াছিলেন— তিনি কেবল প্রসন্ন শান্ত মুখে মাঝে মাঝে হাসিয়াছেন এবং দুটো-একটা কথায় যোগ দিয়াছেন। বিদায় লইবার সময় চৌকি হইতে উঠিয়া বলিলেন, “আমাদের আটাত্তর নম্বরের বাড়িটা এখান থেকে বরাবর ডান-হাতি গিয়ে— ”
সতীশ কহিল, “উনি আমাদের বাড়ি জানেন। উনি যে সেদিন আমার সঙ্গে বরাবর আমাদের দরজা পর্যন্ত গিয়েছিলেন।”
এ কথায় লজ্জা পাইবার কোনোই প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু বিনয় মনে মনে লজ্জিত হইয়া উঠিল। যেন কী-একটা তাহার ধরা পড়িয়া গেল।
বৃদ্ধ কহিলেন, “তবে তো আপনি আমাদের বাড়ি জানেন। তা হলে যদি কখনো আপনার—”
বিনয়। সে আর বলতে হবে না। যখনই—
পরেশ। আমাদের এ তো একই পাড়া— কেবল কলকাতা বলেই এতদিন চেনা-শোনা হয় নি।
বিনয় রাস্তা পর্যন্ত পরেশকে পৌঁছাইয়া দিল। দ্বারের কাছে কিছুক্ষণ সে দাঁড়াইয়া রহিল। পরেশ লাঠি লইয়া ধীরে ধীরে চলিলেন— আর সতীশ ক্রমাগত বকিতে বকিতে তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে চলিল।
বিনয় মনে মনে বলিতে লাগিল, পরেশবাবুর মতো এমন বৃদ্ধ দেখি নাই, পায়ের ধুলা লইতে ইচ্ছা করে। আর সতীশ ছেলেটি কী চমৎকার! বাঁচিয়া থাকিলে এ একজন মানুষ হইবে— যেমন বুদ্ধি তেমনি সরলতা।
এই বৃদ্ধ এবং বালকটি যতই ভালো হোক এত অল্পক্ষণের পরিচয়ে তাহাদের সম্বন্ধে এতটা পরিমাণে ভক্তি ও স্নেহের উচ্ছ্বাস সাধারণত সম্ভবপর হইতে পারিত না। কিন্তু বিনয়ের মনটা এমন অবস্থায় ছিল যে, সে অধিক পরিচয়ের অপেক্ষা রাখে নাই।
তাহার পরে বিনয় মনে মনে ভাবিতে লাগিল— পরেশবাবুর বাড়িতে যাইতেই হইবে, নহিলে ভদ্রতা রক্ষা হইবে না।