মেয়েদের সঙ্গে যে যুবকটি আসিয়াছিল তাহার সঙ্গেও বিনয়ের আলাপ হইয়া গেল। তাহার নাম সুধীর। সে কালেজে বি. এ. পড়ে। চেহারাটি প্রিয়দর্শন, রঙ গৌর, চোখে চশমা, অল্প গোঁফের রেখা উঠিয়াছে। ভাবখানা অত্যন্ত চঞ্চল— এক দণ্ড বসিয়া থাকিতে চায় না, একটা কিছু করিবার জন্য ব্যস্ত। সর্বদাই মেয়েদের সঙ্গে ঠাট্টা করিয়া, বিরক্ত করিয়া, তাহাদিগকে অস্থির করিয়া রাখিয়াছে। মেয়েরাও তাহার প্রতি কেবলই তর্জন করিতেছে, কিন্তু সুধীরকে নহিলে তাহাদের কোনোমতেই চলে না। সার্কাস দেখাইতে, জুঅলজিকাল গার্ডেনে লইয়া যাইতে, কোনো শখের জিনিস কিনিয়া আনিতে, সুধীর সর্বদাই প্রস্তুত। মেয়েদের সঙ্গে সুধীরের অসংকোচ হৃদ্যতার ভাব বিনয়ের কাছে অত্যন্ত নূতন এবং বিস্ময়কর ঠেকিল। প্রথমটা সে এইরূপ ব্যবহারকে মনে মনে নিন্দাই করিল, কিন্তু সে নিন্দার সঙ্গে একটু যেন ঈর্ষার ভাব মিশিতে লাগিল।
বরদাসুন্দরী কহিলেন, “মনে হচ্ছে আপনাকে যেন দুই-একবার সমাজে দেখেছি।”
বিনয়ের মনে হইল যেন তাহার কী একটা অপরাধ ধরা পড়িল। সে অনাবশ্যক লজ্জা প্রকাশ করিয়া কহিল, “হাঁ, আমি কেশববাবুর বক্তৃতা শুনতে মাঝে মাঝে যাই।”
বরদাসুন্দরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি বুঝি কলেজে পড়ছেন?”
বিনয় কহিল, “না, এখন আর কলেজে পড়ি নে।”
বরদা কহিলেন, “আপনি কলেজে কতদূর পর্যন্ত পড়েছেন?”
বিনয় কহিল, “এম. এ. পাস করেছি।”
শুনিয়া এই বালকের মতো চেহারা যুবকের প্রতি বরদাসুন্দরীর শ্রদ্ধা হইল। তিনি নিশ্বাস ফেলিয়া পরেশের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “আমার মনু যদি থাকত তবে সেও এতদিনে এম. এ. পাস করে বের হত।
বরদার প্রথম সন্তান মনোরঞ্জন নয় বছর বয়সে মারা গেছে। যে-কোনো যুবক কোনো বড়ো পাস করিয়াছে, বা বড়ো পদ পাইয়াছে, ভালো বই লিখিয়াছে, বা কোনো ভালো কাজ করিয়াছে শোনেন, বরদার তখনই মনে হয় মনু বাঁচিয়া থাকিলে তাহার দ্বারাও ঠিক এইগুলি ঘটিত। যাহা হউক সে যখন নাই তখন বর্তমানে জনসমাজে তাঁহার মেয়ে তিনটির গুণপ্রচারই বরদাসুন্দরীর একটা বিশেষ কর্তব্যের মধ্যে ছিল। তাঁহার মেয়েরা যে খুব পড়াশুনা করিতেছে এ কথা বরদা বিশেষ করিয়া বিনয়কে জানাইলেন, মেম তাঁহার মেয়েদের বুদ্ধি ও গুণপনা সম্বন্ধে কবে কী বলিয়াছিল তাহাও বিনয়ের অগোচর রহিল না। যখন মেয়ে-ইস্কুলে প্রাইজ দিবার সময় লেফটেনেন্ট্ গবর্নর এবং তাঁহার স্ত্রী আসিয়াছিলেন তখন তাঁহাদিগকে তোড়া দিবার জন্য ইস্কুলের সমস্ত মেয়েদের মধ্যে লাবণ্যকেই বিশেষ করিয়া বাছিয়া লওয়া হইয়াছিল এবং গবর্নরের স্ত্রী লাবণ্যকে উৎসাহজনক কী-একটা মিষ্টবাক্য বলিয়াছিলেন তাহাও বিনয় শুনিল।
অবশেষে বরদা লাবণ্যকে বলিলেন, “যে সেলাইটার জন্যে তুমি প্রাইজ পেয়েছিলে সেইটে নিয়ে এসো তো মা।”
একটা পশমের-সেলাই-করা টিয়াপাখির মূর্তি এই বাড়ির আত্মীয়বন্ধুদের নিকট বিখ্যাত হইয়া উঠিয়াছিল। মেমের সহযোগিতায় এই জিনিসটা লাবণ্য অনেক দিন হইল রচনা করিয়াছিল, এই রচনায় লাবণ্যের নিজের কৃতিত্ব যে খুব বেশি ছিল তাহাও নহে— কিন্তু নূতন-আলাপী মাত্রকেই এটা দেখাইতে হইবে সেটা ধরা কথা। পরেশ প্রথম প্রথম আপত্তি করিতেন, কিন্তু সম্পূর্ণ নিষ্ফল জানিয়া এখন আর আপত্তিও করেন না। এই পশমের টিয়াপাখির রচনানৈপুণ্য লইয়া যখন বিনয় দুই চক্ষু বিস্ময়ে বিস্ফারিত করিয়াছে তখন বেহারা আসিয়া একখানি চিঠি পরেশের হাতে দিল।
চিঠি পড়িয়া পরেশ প্রফুল্ল হইয়া উঠিলেন; কহিলেন, “বাবুকে উপরে নিয়ে আয়।”
বরদা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে?”