পরেশ গোরার কাছে তাঁহার বাল্যবন্ধু কৃষ্ণদয়ালের খবর লইলেন। তাহার পরে নিজেদের ছাত্র-অবস্থার কথা আলোচনা করিয়া বলিলেন, “তখনকার দিনে কলেজে আমরা দুজনেই একজুড়ি ছিলুম— দুজনেই মস্ত কালাপাহাড়— কিছুই মানতুম না— হোটেলে খাওয়াটাই একটা কর্তব্যকর্ম বলে মনে করতুম। দুজনে কতদিন সন্ধ্যার সময় গোলদিঘিতে বসে মুসলমান দোকানের কাবাব খেয়ে তার পরে কী রকম করে আমরা হিন্দুসমাজের সংস্কার করব রাত দুপুর পর্যন্ত তারই আলোচনা করতুম।”
বরদাসুন্দরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন তিনি কী করেন?”
গোরা কহিল, “এখন তিনি হিন্দু-আচার পালন করেন।”
বরদা কহিলেন, “লজ্জা করে না?” — রাগে তাঁহার সর্বাঙ্গ জ্বলিতেছিল।
গোরা একটু হাসিয়া কহিল, “লজ্জা করাটা দুর্বল স্বভাবের লক্ষণ। কেউ কেউ বাপের পরিচয় দিতে লজ্জা করে।”
বরদা। আগে তিনি ব্রাহ্ম ছিলেন না?
গোরা। আমিও তো এক সময়ে ব্রাহ্ম ছিলুম।
বরদা। এখন আপনি সাকার-উপাসনায় বিশ্বাস করেন?
গোরা। আকার জিনিসটাকে বিনা কারণে অশ্রদ্ধা করব আমার মনে এমন কুসংস্কার নেই। আকারকে গাল দিলেই কি সে ছোটো হয়ে যায়? আকারের রহস্য কে ভেদ করতে পেরেছে?
পরেশবাবু মৃদুস্বরে কহিলেন, “আকার যে অন্তবিশিষ্ট।”
গোরা কহিল, “অন্ত না থাকলে যে প্রকাশই হয় না। অনন্ত আপনাকে প্রকাশ করবার জন্যই অন্তকে আশ্রয় করেছেন— নইলে তাঁর প্রকাশ কোথায়? যার প্রকাশ নেই তার সম্পূর্ণতা নেই। বাক্যের মধ্যে যেমন ভাব তেমনি আকারের মধ্যে নিরাকার পরিপূর্ণ।”
বরদা মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “নিরাকারের চেয়ে আকার সম্পূর্ণ আপনি এমন কথা বলেন?”
গোরা। আমি যদি নাও বলতুম তাতে কিছুই আসত যেত না। জগতে আকার আমার বলার উপর নির্ভর করছে না। নিরাকারই যদি যথার্থ পরিপূর্ণতা হত তবে আকার কোথাও স্থান পেত না।
সুচরিতার অত্যন্ত ইচ্ছা করিতে লাগিল কেহ এই উদ্ধত যুবককে তর্কে একেবারে পরাস্ত লাঞ্ছিত করিয়া দেয়। বিনয় চুপ করিয়া বসিয়া গোরার কথা শুনিতেছে দেখিয়া তাহার মনে মনে রাগ হইল। গোরা এতই জোরের সঙ্গে কথা বলিতেছিল যে, এই জোরকে নত করিয়া দিবার জন্য সুচরিতার মনের মধ্যেও যেন জোর করিতে লাগিল।
এমন সময়ে বেহারা চায়ের জন্য কাৎলিতে গরম জল আনিল। সুচরিতা উঠিয়া চা তৈরি করিতে নিযুক্ত হইল। বিনয় মাঝে মাঝে চকিতের মতো সুচরিতার মুখের দিকে চাহিয়া লইল। যদিচ উপাসনা সম্বন্ধে গোরার সঙ্গে বিনয়ের মতের বিশেষ পার্থক্য ছিল না, তবু গোরা যে এই ব্রাহ্ম-পরিবারের মাঝখানে অনাহূত আসিয়া বিরুদ্ধ মত এমন অসংকোচে প্রকাশ করিয়া যাইতেছে ইহাতে বিনয়কে পীড়া দিতে লাগিল। গোরার এইপ্রকার যুদ্ধোদ্যত আচরণের সহিত তুলনা করিয়া বৃদ্ধ পরেশের একটি আত্মসমাহিত প্রশান্ত ভাব, সকলপ্রকার তর্কবিতর্কের অতীত একটি গভীর প্রসন্নতা বিনয়ের হৃদয়কে ভক্তিতে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল। সে মনে মনে বলিতে লাগিল, মতামত কিছুই নয়— অন্তঃকরণের মধ্যে পূর্ণতা স্তব্ধতা ও আত্মপ্রসাদ ইহাই সকলের চেয়ে দুর্লভ। কথাটার মধ্যে কোন্টা সত্য কোন্টা মিথ্যা তাহা লইয়া যতই তর্ক কর-না কেন, প্রাপ্তির মধ্যে যেটা সত্য সেইটাই আসল। পরেশ সকল কথাবার্তার মধ্যে মধ্যে এক-একবার চোখ বুজিয়া নিজের অন্তরের মধ্যে তলাইয়া লইতেছিলেন— ইহা তাঁহার অভ্যাস— তাঁহার সেই-সময়কার