আনন্দময়ী কহিলেন, “বাবা গোরা, আমার একটি কথা রাখিস— বিনয়ের সঙ্গে ঝগড়া করিস নে। আমার কাছে তোরা দুজনে দুটি ভাই— তোদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটলে আমি সইতে পারব না।”
গোরা কহিল, “বন্ধু যদি বন্ধন কাটতে চায় তবে তার পিছনে ছুটোছুটি করে আমি সময় নষ্ট করতে পারব না।”
আনন্দময়ী কহিলেন, “বাবা, আমি জানি নে তোমাদের মধ্যে কী হয়েছে। কিন্তু বিনয় তোমার বন্ধন কাটাতে চাচ্ছে এ কথা যদি বিশ্বাস কর তবে তোমার বন্ধুত্বের জোর কোথায়?”
গোরা। মা, আমি সোজা চলতে ভালোবাসি, যারা দু দিক রাখতে চায় আমার সঙ্গে তাদের বনবে না। দু নৌকোয় পা দেওয়া যার স্বভাব আমার নৌকো থেকে তাকে পা সরাতে হবে— এতে আমারই কষ্ট হোক আর তারই কষ্ট হোক।
আনন্দময়ী। কী হয়েছে বল্ দেখি। ব্রাহ্মদের ঘরে সে আসা-যাওয়া করে এই তো তার অপরাধ?
গোরা। সে অনেক কথা মা।
আনন্দময়ী। হোক অনেক কথা— কিন্তু আমি একটি কথা বলি, গোরা, সব বিষয়েই তোমার এত জেদ যে, তুমি যা ধর তা কেউ ছাড়াতে পারে না। কিন্তু বিনয়ের বেলাই তুমি এমন আলগা কেন? তোমার অবিনাশ যদি দল ছাড়তে চাইত তুমি কি তাকে সহজে ছাড়তে? তোমার বন্ধু বলেই কি ও তোমার সকলের চেয়ে কম?
গোরা চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিল। আনন্দময়ীর এই কথাতে সে নিজের মনটা পরিষ্কার দেখিতে পাইল। এতক্ষণ সে মনে করিতেছিল যে, সে কর্তব্যের জন্য তাহার বন্ধুত্বকে বিসর্জন দিতে যাইতেছে, এখন স্পষ্ট বুঝিল ঠিক তাহার উলটা। তাহার বন্ধুত্বের অভিমানে বেদনা লাগিয়াছে বলিয়াই বিনয়কে বন্ধুত্বের চরম শাস্তি দিতে সে উদ্যত হইয়াছে। সে মনে জানিত বিনয়কে বাঁধিয়া রাখিবার জন্য বন্ধুত্বই যথেষ্ট— অন্য কোনোপ্রকার চেষ্টা প্রণয়ের অসম্মান।
আনন্দময়ী যেই বুঝিলেন তাঁহার কথাটা গোরার মনে একটুখানি লাগিয়াছে অমনি তিনি আর কিছু না বলিয়া আস্তে আস্তে উঠিবার উপক্রম করিলেন। গোরাও হঠাৎ বেগে উঠিয়া পড়িয়া আলনা হইতে চাদর তুলিয়া কাঁধে ফেলিল।
আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় যাও গোরা?”
গোরা কহিল, “আমি বিনয়ের বাড়ি যাচ্ছি।”
আনন্দময়ী। খাবার তৈরি আছে খেয়ে যাও।
গোরা। আমি বিনয়কে ধরে আনছি, সেও এখানে খাবে।
আনন্দময়ী আর কিছু না বলিয়া নীচের দিকে চলিলেন। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনিয়া হঠাৎ থামিয়া কহিলেন, “ঐ বিনয় আসছে।”
বলিতে বলিতে বিনয় আসিয়া পড়িল। আনন্দময়ীর চোখ ছল্ছল্ করিয়া আসিল। তিনি স্নেহে বিনয়ের গায়ে হাত দিয়া কহিলেন, “বিনয়, বাবা, তুমি খেয়ে আস নি?”
বিনয় কহিল, “না, মা!”
আনন্দময়ী। তোমাকে এইখানেই খেতে হবে।
বিনয় একবার গোরার মুখের দিকে চাহিল। গোরা কহিল, “বিনয়, অনেক দিন বাঁচবে। তোমার ওখানেই যাচ্ছিলুম।”
আনন্দময়ীর বুক হালকা হইয়া গেল— তিনি তাড়াতাড়ি নীচে চলিয়া গেলেন।
দুই বন্ধু ঘরে আসিয়া বসিলে গোরা যাহা-তাহা একটা কথা তুলিল— কহিল, “জান, আমাদের ছেলেদের জন্যে একজন বেশ ভালো জিমনাষ্টিক মাস্টার পেয়েছি। সে শেখাচ্ছে বেশ।”