এরূপ ভাবে পরীক্ষা করিতে গেলে পরীক্ষা দিতেও হয়। হারানবাবু পরেশবাবুর ঘরে সুপরিচিত হইয়া উঠিলেন। তাঁহাকে তাঁহার বাড়ির লোকে যে পানুবাবু বলিয়া ডাকিত, এ পরিবারেও তাঁহার সেই পানুবাবু নাম প্রচার হইল। এখন তাঁহাকে কেবলমাত্র ইংরেজি বিদ্যার ভাণ্ডার, তত্ত্বজ্ঞানের আধার ও ব্রাহ্মসমাজের মঙ্গলের অবতাররূপে দেখা সম্ভবপর হইল না— তিনি যে মানুষ, এই পরিচয়টাই সকলের চেয়ে নিকট হইয়া উঠিল। তখন তিনি কেবলমাত্র শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের অধিকারী না হইয়া ভালোলাগা মন্দলাগার আয়ত্তাধীন হইয়া আসিলেন।
আশ্চর্যের বিষয় এই যে, হারানবাবুকে যে ভাবটা পূর্বে দূর হইতে সুচরিতার ভক্তি আকর্ষণ করিয়াছিল সেই ভাবটাই নিকটে আসিয়া তাহাকে আঘাত করিতে লাগিল। ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে যাহা-কিছু সত্য মঙ্গল ও সুন্দর আছে হারানবাবু তাহার অভিভাবকস্বরূপ হইয়া তাহার রক্ষকতার ভার লওয়াতে তাঁহাকে অত্যন্ত অসংগতরূপে ছোটো দেখিতে হইল। সত্যের সঙ্গে মানুষের যথার্থ সম্বন্ধ ভক্তির সম্বন্ধ— তাহাতে মানুষকে স্বভাবতই বিনয়ী করিয়া তোলে। তাহা না করিয়া যেখানে মানুষকে উদ্ধত ও অহংকৃত করে সেখানে মানুষ আপনার ক্ষুদ্রতাকে সেই সত্যের তুলনাতেই অত্যন্ত সুস্পষ্ট করিয়া প্রকাশ করে। এইখানেই পরেশবাবুর সঙ্গে হারানের প্রভেদ সুচরিতা মনে মনে আলোচনা না করিয়া থাকিতে পারিল না। পরেশবাবু ব্রাহ্মসমাজের নিকট হইতে যাহা লাভ করিয়াছেন তাহার সম্মুখে তাঁহার মাথা যেন সর্বদা নত হইয়া আছে— সে সম্বন্ধে তাঁহার লেশমাত্র প্রগল্ভতা নাই— তাহার গভীরতার মধ্যে তিনি নিজের জীবনকে তলাইয়া দিয়াছেন। পরেশবাবুর শান্ত মুখচ্ছবি দেখিলে তিনি যে সত্যকে হৃদয়ে বহন করিতেছেন তাহারই মহত্ত্ব চোখে পড়ে। কিন্তু হারানবাবুর সেরূপ নহে— তাঁহার ব্রাহ্মত্ব বলিয়া একটা উগ্র আত্মপ্রকাশ অন্য সমস্ত আচ্ছন্ন করিয়া তাঁহার সমস্ত কথায় ও কাজে অশোভনরূপে বাহির হইয়া থাকে। ইহাতে সম্প্রদায়ের কাছে তাঁহার আদর বাড়িয়াছিল; কিন্তু সুচরিতা পরেশের শিক্ষাগুণে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার মধ্যে আবদ্ধ হইতে পারে নাই বলিয়া হারানবাবুর একান্ত ব্রাহ্মিকতা সুচরিতার স্বাভাবিক মানবত্বকে যেন পীড়া দিত। হারানবাবু মনে করিতেন, ধর্মসাধনার ফলে তাঁহার দৃষ্টিশক্তি এমন আশ্চর্য স্বচ্ছ হইয়াছে যে, অন্য সকল লোকেরই ভালোমন্দ ও সত্যাসত্য তিনি অতি অনায়াসেই বুঝিতে পারেন। এইজন্য সকলকেই তিনি সর্বদাই বিচার করিতে উদ্যত। বিষয়ী লোকেরাও পরনিন্দা পরচর্চা করিয়া থাকে, কিন্তু যাহারা ধার্মিকতার ভাষায় এই কাজ করে তাহাদের সেই নিন্দার সঙ্গে আধ্যাত্মিক অহংকার মিশ্রিত হইয়া সংসারে একটা অত্যন্ত সুতীব্র উপদ্রবের সৃষ্টি করে। সুচরিতা তাহা একেবারেই সহিতে পারিত না। ব্রাহ্মসম্প্রদায় সম্বন্ধে সুচরিতার মনে যে কোনো গর্ব ছিল না তাহা নহে, তথাপি ব্রাহ্ম সমাজের মধ্যে যাঁহারা বড়োলোক তাঁহারা যে ব্রাহ্ম হওয়ারই দরুন বিশেষ একটা শক্তি লাভ করিয়া বড়ো হইয়াছেন এবং ব্রাহ্ম সমাজের বাহিরে যাহারা চরিত্রভ্রষ্ট তাহারা যে ব্রাহ্ম না হওয়ারই কারণে বিশেষভাবে শক্তিহীন হইয়া নষ্ট হইয়াছে এ কথা লইয়া হারানবাবুর সঙ্গে সুচরিতার অনেক বার তর্ক হইয়া গিয়াছে।
হারানবাবু ব্রাহ্মসমাজের মঙ্গলের প্রতি লক্ষ করিয়া যখন বিচারে পরেশবাবুকেও অপরাধী করিতে ছাড়িতেন না তখনই সুচরিতা যেন আহত ফণিনীর মতো অসহিষ্ণু হইয়া উঠিত। সে সময়ে বাংলাদেশে ইংরেজিশিক্ষিত দলের মধ্যে ভগবদ্গীতা লইয়া আলোচনা ছিল না। কিন্তু পরেশবাবু সুচরিতাকে লইয়া মাঝে মাঝে গীতা পড়িতেন— কালীসিংহের মহাভারতও তিনি প্রায় সমস্তটা সুচরিতাকে পড়িয়া শুনাইয়াছেন। হারানবাবুর কাছে তাহা ভালো লাগে নাই। এ-সমস্ত গ্রন্থ তিনি ব্রাহ্মপরিবার হইতে নির্বাসিত করিবার পক্ষপাতী। তিনি নিজেও এগুলি পড়েন নাই। রামায়ণ-মহাভারত-ভগবদ্গীতাকে তিনি হিন্দুদের সামগ্রী বলিয়া স্বতন্ত্র রাখিতে চাহিতেন। ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে বাইব্লই তাঁহার একমাত্র অবলম্বন ছিল। পরেশবাবু যে তাঁহার শাস্ত্রচর্চা এবং ছোটোখাটো নানা বিষয়ে ব্রাহ্ম-অব্রাহ্মের সীমা রক্ষা করিয়া চলিতেন না, তাহাতে হারানের গায়ে যেন কাঁটা বিঁধিত। পরেশের আচরণে প্রকাশ্যে বা মনে মনে কেহ কোনোপ্রকার দোষারোপ করিবে এমন স্পর্ধা সুচরিতা কখনোই সহিতে পারে না। এবং এইরূপ স্পর্ধা প্রকাশ হইয়া পড়াতেই