আদিত্যকে) সরলাকে তুমি বিয়ে করলে না কেন?
আদিত্য। শোনো একবার কথা! বিয়ের কথা কোনোদিন মনেও আসে নি।
নীরজা। মনেও আসে নি? এই বুঝি তোমার কবিত্ব!
আদিত্য। জীবনে কবিত্বের বালাই প্রথম দেখা দিল যেদিন তোমাকে দেখলুম। তার আগে আমরা দুই বুনো মিলে দিন কাটিয়েছি বনের ছায়ায়, নিজেদের ছিলুম ভুলে। হাল আমলের সভ্যতায় যদি মানুষ হতুম তা হলে কী হত বলা যায় না।
নীরজা। কেন, সভ্যতার অপরাধটা কী?
আদিত্য। এখনকার সভ্যতাটা দুঃশাসনের মতো হৃদয়ের বস্ত্র হরণ করতে চায়। অনুভব করবার পূর্বেই জানিয়ে দেয় চোখে আঙুল দিয়ে। গন্ধের ইশারা ওর পক্ষে বেশি সূক্ষ্ম, খবর নেয় পাপড়ি ছিঁড়ে।
নীরজা। সরলাকে তো দেখতে মন্দ নয়।
আদিত্য। সরলাকে জানতুম সরলা বলেই। ও দেখতে ভালো কি মন্দ সে তত্ত্বটা সম্পূর্ণ বাহুল্য ছিল।
নীরজা। আচ্ছা সত্যি বলো. ওকে তুমি ভালোবাসতে না?
আদিত্য। নিশ্চয় ভালোবাসতুম। আমি কি জড়পদার্থ যে, ওকে ভালোবাসব না। মেশোমশায়ের ছেলে রেঙ্গুনে ব্যারিস্টারি করে, তার জন্যে কোনো ভাবনা নেই। তাঁর বাগানটি নিয়ে সরলা থাকবে এই ছিল তাঁর জীবনের সাধ। এমন-কি, তাঁর বিশ্বাস ছিল, এই বাগানই ওর সমস্ত মনপ্রাণ অধিকার করবে। ওর বিয়ে করবার গরজ থাকবে না। তার পরে তিনি চলে গেলেন। অনাথা হল সরলা, পাওনাদারের হাতে বাগানটি গেল বিকিয়ে। সেদিন আমার বুক ভেঙে গিয়েছিল, দেখো নি কি তুমি? ও যে ভালোবাসার জিনিস, ভালোবাসব না ওকে? মনে তো আছে একদিন সরলার মুখে হাসিখুশি ছিল উচ্ছ্বসিত। মনে হত যেন পাখির ওড়া ছিল ওর পায়ের চলার মধ্যে। আজ ও চলেছে বুকভরা বোঝা বয়ে বয়ে, তবু ভেঙে পড়ে নি। একদিনের জন্যে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নি আমারও কাছে, নিজেকে তার অবকাশও দিলে না।
নীরজা। থামো গো থামো, অনেক শুনেছি ওর কথা তোমার কাছে; আর বলতে হবে না। অসামান্য মেয়ে। সেইজন্যে বলছি ওকে সেই বারাসতের মেয়ে-স্কুলের হেড্মিস্ট্রেস করে দাও। তারা তো কতবার ধরাধরি করেছে।
আদিত্য। বারাসতের মেয়ে-ইস্কুল! কেন, আণ্ডামানও তো আছে?
নীরজা। না, ঠাট্টা নয়। সরলাকে তোমার বাগানের আর যে-কোনো কাজ দিতে হয় দিয়ো কিন্তু ঐ অর্কিড-ঘরের কাজ দিতে পারবে না।
আদিত্য। কেন, হয়েছে কী?
নীরজা। আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি সরলা অর্কিড ভালো বোঝে না।
আদিত্য। আমিও তোমাকে বলছি, আমার চেয়ে সরলা ভালো বোঝে। মেসোমশায়ের প্রধান শখ ছিল অর্কিডে। তিনি নিজের লোক পাঠিয়ে সেলিবিস দ্বীপ থেকে, জাভা থেকে, এমন-কি, চীন থেকে অর্কিড আনিয়েছেন, তার দরদ বোঝে এমন লোক তখন কেউ ছিল না।
নীরজা। আচ্ছা, আচ্ছা, বেশ বেশ, ও না-হয় আমার চেয়ে ঢের ভালো বোঝে, এমন-কি, তোমার চেয়েও। তা হোক, তবু বলছি ঐ অর্কিডের ঘর শুধু কেবল তোমার আমার, ওখানে সরলার কোনো অধিকার নেই। তোমার সমস্ত বাগানটা ওকেই দিয়ে দাও-না যদি তোমার নিতান্ত ইচ্ছে হয়, কেবল খুব অল্প একটু কিছু রেখো যেটুকু কেবল আমাকেই উৎসর্গ-করা। এতকাল পরে অন্তত এইটুকু দাবি করতে পারি। কপাল-দোষে না-হয় আজ আছি বিছানায় পড়ে, তাই বলে—