গোরা। দিন আর রাত্রি, সময়ের এই যেমন দুটো ভাগ— পুরুষ এবং মেয়েও তেমনি সমাজের দুই অংশ। সমাজের স্বাভাবিক অবস্থায় স্ত্রীলোক রাত্রির মতোই প্রচ্ছন্ন— তার সমস্ত কাজ নিগূঢ় এবং নিভৃত। আমাদের কর্মের হিসাব থেকে আমরা রাতকে বাদ দিই। কিন্তু বাদ দিই বলে তার যে গভীর কর্ম তার কিছুই বাদ পড়ে না। সে গোপন বিশ্রামের অন্তরালে আমাদের ক্ষতিপূরণ করে, আমাদের পোষণের সহায়তা করে। যেখানে সমাজের অস্বাভাবিক অবস্থা সেখানে রাতকে জোর করে দিন করে তোলে— সেখানে গ্যাস জ্বালিয়ে কল চালানো হয়, বাতি জ্বালিয়ে সমস্ত রাত নাচ-গান হয়— তাতে ফল কী হয়! ফল এই হয় যে, রাত্রির যে স্বাভাবিক নিভৃত কাজ তা নষ্ট হয়ে যায়, ক্লান্তি বাড়তে থাকে, ক্ষতিপূরণ হয় না, মানুষ উন্মত্ত হয়ে ওঠে। মেয়েদেরও যদি তেমনি আমরা প্রকাশ্য কর্মক্ষেত্রে টেনে আনি তা হলে তাদের নিগূঢ় কর্মের ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়— তাতে সমাজের স্বাস্থ্য ও শান্তি-ভঙ্গ হয়, সমাজে একটা মত্ততা প্রবেশ করে। সেই মত্ততাকে হঠাৎ শক্তি বলে ভ্রম হয়, কিন্তু সে শক্তি বিনাশ করবারই শক্তি। শক্তির দুটো অংশ আছে— এক অংশ ব্যক্ত আর-এক অংশ অব্যক্ত, এক অংশ উদ্যোগ আর-এক অংশ বিশ্রাম, এক অংশ প্রয়োগ আর-এক অংশ সংবরণ— শক্তির এই সামঞ্জস্য যদি নষ্ট কর তা হলে সে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, কিন্তু সে ক্ষোভ মঙ্গলকর নয়। নরনারী সমাজশক্তির দুই দিক; পুরুষই ব্যক্ত, কিন্তু ব্যক্ত বলেই যে মস্ত তা নয়— নারী অব্যক্ত, এই অব্যক্ত শক্তিকে যদি কেবলই ব্যক্ত করবার চেষ্টা করা হয় তা হলে সমস্ত মূলধন খরচ করে ফেলে সমাজকে দ্রুতবেগে দেউলে করবার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেইজন্যে বলছি আমরা পুরুষরা যদি থাকি যজ্ঞের ক্ষেত্রে, মেয়েরা যদি থাকেন ভাঁড়ার আগলে, তা হলেই মেয়েরা অদৃশ্য থাকলেও যজ্ঞ সুসম্পন্ন হবে। সব শক্তিকেই একই দিকে একই জায়গায় একই রকমে খরচ করতে চায় যারা তারা উন্মত্ত।
বিনয়। গোরা, তুমি যা বললে আমি তার প্রতিবাদ করতে চাই নে— কিন্তু আমি যা বলছিলুম তুমিও তার প্রতিবাদ কর নি। আসল কথা—
গোরা। দেখো বিনয়, এর পরে এ কথাটা নিয়ে আর অধিক যদি বকাবকি করা যায় তা হলে সেটা নিতান্ত তর্ক হয়ে দাঁড়াবে। আমি স্বীকার করছি, তুমি সম্প্রতি মেয়েদের সম্বন্ধে যতটা সচেতন হয়ে উঠেছ আমি ততটা হই নি— সুতরাং তুমি যা অনুভব করছ আমাকেও তাই অনুভব করাবার চেষ্টা করা কখনো সফল হবে না। অতএব এ সম্বন্ধে আপাতত আমাদের মতভেদ রইল বলেই মেনে নেওয়া যাক-না।
গোরা কথাটাকে উড়াইয়া দিল। কিন্তু বীজকে উড়াইয়া দিলেও সে মাটিতে পড়ে এবং মাটিতে পড়িলে সুযোগমত অঙ্কুরিত হইতে বাধা থাকে না। এপর্যন্ত জীবনের ক্ষেত্র হইতে গোরা স্ত্রীলোককে একেবারেই সরাইয়া রাখিয়াছিল— সেটাকে একটা অভাব বা ক্ষতি বলিয়া সে কখনো স্বপ্নেও অনুভব করে নাই। আজ বিনয়ের অবস্থান্তর দেখিয়া সংসারে স্ত্রীজাতির বিশেষ সত্তা ও প্রভাব তাহার কাছে গোচর হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু ইহার স্থান কোথায়, ইহার প্রয়োজন কী, তাহা সে কিছুই স্থির করিতে পারে নাই, এইজন্য বিনয়ের সঙ্গে এ কথা লইয়া তর্ক করিতে তাহার ভালো লাগে না। বিষয়টাকে সে অস্বীকার করিতেও পারে না, আয়ত্ত করিতেও পারিতেছে না, এইজন্য ইহাকে আলোচনার বাহিরে রাখিতে চায়।
রাত্রে বিনয় যখন বাসায় ফিরিতেছিল তখন আনন্দময়ী তাহাকে ডাকিয়া কহিলেন, “শশিমুখীর সঙ্গে বিনয় তোমার বিবাহ নাকি ঠিক হয়ে গেছে?”
বিনয় সলজ্জ হাস্যের সহিত কহিল, “হাঁ মা, গোরা এই শুভকর্মের ঘটক।”
আনন্দময়ী কহিলেন, “শশিমুখী মেয়েটি ভালো, কিন্তু বাছা, ছেলেমানুষি কোরো না। আমি তোমার মন জানি বিনয়— একটু দোমনা হয়েছ বলেই তাড়াতাড়ি এ কাজ করে ফেলছ। এখনো বিবেচনা করে দেখবার সময় আছে; তোমার বয়স হয়েছে বাবা— এতবড়ো একটা কাজ অশ্রদ্ধা করে কোরো না।”