গোরা তাহার লেখা ছাড়িয়া মুখ তুলিয়া কহিল, “বিনয়, একবার যখন তুমি দাদাকে কথা দিয়েছ তখন কেন ওঁকে অনিশ্চিতের মধ্যে রেখে মিথ্যে কষ্ট দিচ্ছ?”
বিনয় হঠাৎ অসহিষ্ণু হইয়া বলিয়া উঠিল, “আমি কথা দিয়েছি— না তাড়াতাড়ি আমার কাছ থেকে কথা কেড়ে নেওয়া হয়েছে?”
গোরা বিনয়ের এই অকস্মাৎ বিদ্রোহের লক্ষণ দেখিয়া বিস্মিত এবং কঠিন হইয়া উঠিয়া কহিল, “কথা কে কেড়ে নিয়েছিল?”
বিনয় কহিল, “তুমি।”
গোরা। আমি! তোমার সঙ্গে এ সম্বন্ধে আমার পাঁচ-সাতটার বেশি কথাই হয় নি— তাকে বলে কথা কেড়ে নেওয়া!
বস্তুত বিনয়ের পক্ষে স্পষ্ট প্রমাণ কিছুই ছিল না— গোরা যাহা বলিতেছে তাহা সত্য— কথা অল্পই হইয়াছিল এবং তাহার মধ্যে এমন কিছু বেশি তাগিদ ছিল না যাহাকে পীড়াপীড়ি বলা চলে— তবুও এ কথা সত্য, গোরাই বিনয়ের কাছ হইতে তাহার সম্মতি যেন লুঠ করিয়া লইয়াছিল। যে কথার বাহ্য প্রমাণ অল্প সেই অভিযোগ সম্বন্ধে মানুষের ক্ষোভও কিছু বেশি হইয়া থাকে। তাই বিনয় কিছু অসংগত রাগের সুরে বলিল, “কেড়ে নিতে বেশি কথার দরকার করে না।”
গোরা টেবিল ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “নাও, তোমার কথা ফিরিয়ে নাও। তোমার কাছ থেকে ভিক্ষে করেই নেব না দস্যুবৃত্তি করেই নেব এতবড়ো মহামূল্য কথা এটা নয়।”
পাশের ঘরেই মহিম ছিলেন— গোরা বজ্রস্বরে তাঁহাকে ডাকিল, “দাদা!”
মহিম শশব্যস্ত হইয়া ঘরে আসিতেই গোরা কহিল, “দাদা, আমি তোমাকে গোড়াতেই বলি নি যে শশিমুখীর সঙ্গে বিনয়ের বিবাহ হতে পারে না— আমার তাতে মত নেই!”
মহিম। নিশ্চয় বলেছিলে। তুমি ছাড়া এমন কথা আর কেউ বলতে পারত না। অন্য কোনো ভাই হলে ভাইঝির বিবাহপ্রস্তাবে প্রথম থেকেই উৎসাহ প্রকাশ করত।
গোরা। তুমি কেন আমাকে দিয়ে বিনয়ের কাছে অনুরোধ করালে?
মহিম। মনে করেছিলুম তাতে কাজ পাওয়া যাবে, আর কোনো কারণ নেই।
গোরা মুখ লাল করিয়া বলিল, “আমি এ-সবের মধ্যে নেই। বিবাহের ঘটকালি করা আমার ব্যবসায় নয়, আমার অন্য কাজ আছে।”
এই বলিয়া গোরা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। হতবুদ্ধি মহিম বিনয়কে এ সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করিবার পূর্বেই সেও একেবারে রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। মহিম দেওয়ালের কোণ হইতে হুঁকাটা তুলিয়া লইয়া চুপ করিয়া বসিয়া টান দিতে লাগিলেন।
গোরার সঙ্গে বিনয়ের ইতিপূর্বে অনেক দিন অনেক ঝগড়া হইয়া গিয়াছে, কিন্তু এমন আকস্মিক প্রচন্ড অগ্ন্যুৎপাতের মতো ব্যাপার আর কখনো হয় নাই। বিনয় নিজের কৃত কর্মে প্রথমটা স্তম্ভিত হইয়া গেল। তাহার পরে বাড়ি গিয়া তাহার বুকের মধ্যে শেল বিঁধিতে লাগিল। এই ক্ষণকালের মধ্যেই গোরাকে সে যে কত বড়ো একটা আঘাত দিয়াছে তাহা মনে করিয়া তাহার আহারে বিশ্রামে রুচি রহিল না। বিশেষত এ ঘটনায় গোরাকে দোষী করা যে নিতান্তই অদ্ভুত ও অসংগত হইয়াছে ইহাই তাহাকে দগ্ধ করিতে লাগিল; সে বার বার বলিল, ‘অন্যায়, অন্যায়, অন্যায়!”
বেলা দুইটার সময় আনন্দময়ী সবে যখন আহার সারিয়া সেলাই লইয়া বসিয়াছেন এমন সময় বিনয় আসিয়া তাঁহার কাছে