পুলকিত আনন্দময়ী তাড়াতাড়ি তাহার লজ্জাটা চাপা দিয়া কহিলেন, “বিনয় সঙ্গে যাবে বুঝি?”
গোরা ব্যস্ত হইয়া কহিল, “না মা, বিনয় যাবে না। ঐ দেখো, অমনি মা’র মনে ভাবনা হচ্ছে, বিনয় না গেলে তাঁর গোরাকে পথে ঘাটে রক্ষা করবে কে? বিনয়কে যদি তুমি আমার রক্ষক মনে কর সেটা তোমার একটা কুসংস্কার— এবার নিরাপদে ফিরে এলে ঐ সংস্কারটা তোমার ঘুচবে।”
আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “মাঝে মাঝে খবর পাব তো?”
গোরা কহিল, “খবর পাবে না বলেই ঠিক করে রাখো— তার পরে যদি পাও তো খুশি হবে। ভয় কিছুই নেই; তোমার গোরাকে কেউ নেবে না। মা, তুমি আমার যতটা মূল্য কল্পনা কর আর-কেউ ততটা করে না। তবে এই বোঁচকাটির উপর যদি কারও লোভ হয় তবে এটি তাকে দান করে দিয়ে চলে আসব; এটা রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দান করব না— সে নিশ্চয়।”
গোরা আনন্দময়ীর পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল, তিনি তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া হাত চুম্বন করিলেন, কোনোপ্রকার নিষেধমাত্র করিলেন না। নিজের কষ্ট হইবে বলিয়া অথবা কল্পনায় অনিষ্ট আশঙ্কা করিয়া আনন্দময়ী কখনো কাহাকেও নিষেধ করিতেন না। নিজের জীবনে তিনি অনেক বাধাবিপদের মধ্য দিয়া আসিয়াছেন, বাহিরের পৃথিবী তাঁহার কাছে অপরিচিত নহে; তাঁহার মনে ভয় বলিয়া কিছু ছিল না। গোরা যে কোনো বিপদে পড়িবে সে ভয় তিনি মনে আনেন নাই— কিন্তু গোরার মনের মধ্যে যে কী একটা বিপ্লব ঘটিয়াছে সেই কথাই তিনি কাল হইতে ভাবিতেছেন। আজ হঠাৎ গোরা অকারণে ভ্রমণ করিতে চলিল শুনিয়া তাঁহার সেই ভাবনা আরো বাড়িয়া উঠিয়াছে।
গোরা পিঠে বোঁচকা বাঁধিয়া রাস্তায় যেই পা দিয়াছে এমন সময় হাতে ঘনরক্ত বসোরা গোলাপ-যুগল সযত্নে লইয়া বিনয় তাহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। গোরা কহিল, “বিনয়, তোমার দর্শনে অযাত্রা কি সুযাত্রা এবারে তার পরীক্ষা হবে।”
বিনয় কহিল, “বেরোচ্ছ নাকি?”
গোরা কহিল, “হাঁ।”
বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায়?”
গোরা কহিল, “প্রতিধ্বনি উত্তর করিল ‘কোথায়’।”
বিনয়। প্রতিধ্বনির চেয়ে ভালো উত্তর নেই নাকি?
গোরা। না। তুমি মা’র কাছে যাও, সব শুনতে পাবে। আমি চললুম।
বলিয়া দ্রুতবেগে চলিয়া গেল।
বিনয় অন্তঃপুরে গিয়া আনন্দময়ীকে প্রণাম করিয়া তাঁহার পায়ের ’পরে গোলাপ ফুল দুইটি রাখিল।
আনন্দময়ী ফুল তুলিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কোথায় পেলে বিনয়?”
বিনয় তাহার ঠিক স্পষ্ট উত্তরটি না দিয়া কহিল, “ভালো জিনিসটি পেলেই আগে মায়ের পুজোর জন্যে সেটি দিতে ইচ্ছা করে।”
তার পরে আনন্দময়ীর তক্তপোশের উপর বসিয়া বিনয় কহিল, “মা, তুমি কিন্তু অন্যমনস্ক আছ।”
আনন্দময়ী কহিলেন, “কেন বলো দেখি।”
বিনয় কহিল, “আজ আমার বরাদ্দ পানটা দেবার কথা ভুলেই গেছ।”
আনন্দময়ী লজ্জিত হইয়া বিনয়কে পান আনিয়া দিলেন।
তাহার পরে সমস্ত দুপুরবেলা ধরিয়া দুইজনে কথাবার্তা হইতে লাগিল। গোরার নিরুদ্দেশ-ভ্রমণের অভিপ্রায় সম্বন্ধে বিনয়