ললিতার এই পরিবর্তনে বিনয়ের বুকের উপর হইতে যেন একটা পাথরের বোঝা নামিয়া গেল। এত আনন্দ হইল যে, যখন-তখন আনন্দময়ীর কাছে গিয়া বালকের মতো ছেলেমানুষি করিতে লাগিল। সুচরিতার কাছে বসিয়া অনেক কথা বকিবার জন্য তাহার মনে কথা জমিতে থাকিল, কিন্তু আজকাল সুচরিতার সঙ্গে তাহার দেখাই হয় না। সুযোগ পাইলেই ললিতার সঙ্গে আলাপ করিতে বসিত, কিন্তু ললিতার কাছে তাহাকে বিশেষ সাবধান হইয়াই কথা বলিতে হইত; ললিতা যে মনে মনে তাহাকে এবং তাহার সকল কথাকে তীক্ষ্ণভাবে বিচার করে ইহা জানিত বলিয়া ললিতার সম্মুখে তাহার কথার স্রোতে স্বাভাবিক বেগ থাকিত না। ললিতা মাঝে মাঝে বলিত, “আপনি যেন বই পড়ে এসে কথা বলছেন, এমন করে বলেন কেন?”
বিনয় উত্তর করিত, “আমি যে এত বয়স পর্যন্ত কেবল বই পড়েই এসেছি, সেইজন্য মনটা ছাপার বইয়ের মতো হয়ে গেছে।”
ললিতা বলিত, “আপনি খুব ভালো করে বলবার চেষ্টা করবেন না— নিজের কথাটা ঠিক করে বলে যাবেন। আপনি এমন চমৎকার করে বলেন যে, আমার সন্দেহ হয় আপনি আর-কারও কথা ভেবে সাজিয়ে বলছেন।”
এই কারণে, স্বাভাবিক ক্ষমতাবশত একটা কথা বেশ সুসজ্জিত হইয়া বিনয়ের মনে আসিলে ললিতাকে বলিবার সময় চেষ্টা করিয়া বিনয়কে তাহা সাদা করিয়া এবং স্বল্প করিয়া বলিতে হইত। কোনো একটা অলংকৃত বাক্য তাহার মুখে হঠাৎ আসিলে সে লজ্জিত হইয়া পড়িত।
ললিতার মনের ভিতর হইতে একটা যেন অকারণ মেঘ কাটিয়া গিয়া তাহার হৃদয় উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। বরদাসুন্দরীও তাহার পরিবর্তন দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলেন। সে এখন পূর্বের ন্যায় কথায় কথায় আপত্তি প্রকাশ করিয়া বিমুখ হইয়া বসে না, সকল কাজে উৎসাহের সঙ্গে যোগ দেয়। আগামী অভিনয়ের সাজসজ্জা ইত্যাদি সকল বিষয়ে তাহার মনে প্রত্যহ নানাপ্রকার নূতন নূতন কল্পনার উদয় হইতে লাগিল, তাহাই লইয়া সে সকলকে অস্থির করিয়া তুলিল। এ সম্বন্ধে বরদাসুন্দরীর উৎসাহ যতই বেশি হউক তিনি খরচের কথাটাও ভাবেন— সেইজন্য, ললিতা যখন অভিনয় ব্যাপারে বিমুখ ছিল তখনো যেমন তাঁহার উৎকণ্ঠার কারণ ঘটিয়াছিল এখন তাহার উৎসাহিত অবস্থাতেও তেমনি তাঁহার সংকট উপস্থিত হইল। কিন্তু ললিতার উত্তেজিত কল্পনাবৃত্তিকে আঘাত করিতেও সাহস হয় না, যে কাজে সে উৎসাহ বোধ করে সে কাজের কোথাও লেশমাত্র অসম্পূর্ণতা ঘটিলে সে একেবারে দমিয়া যায়, তাহাতে যোগ দেওয়াই তাহার পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠে।
ললিতা তাহার মনের এই উচ্ছ্বসিত অবস্থায় সুচরিতার কাছে অনেকবার ব্যগ্র হইয়া গিয়াছে। সুচরিতা হাসিয়াছে, কথা কহিয়াছে বটে, কিন্তু ললিতা তাহার মধ্যে বারংবার এমন একটা বাধা অনুভব করিয়াছে যে, সে মনে মনে রাগ করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছে।
একদিন সে পরেশবাবুর কাছে গিয়া কহিল, “বাবা, সুচিদিদি যে কোণে বসে বসে বই পড়বে, আর আমরা অভিনয় করতে যাব, সে হবে না। ওকেও আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে হবে।”
পরেশবাবুও কয়দিন ভাবিতেছিলেন, সুচরিতা তাহার সঙ্গিনীদের নিকট হইতে কেমন যেন দূরবর্তিনী হইয়া পড়িতেছে। এরূপ অবস্থা তাহার চরিত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নহে বলিয়া তিনি আশঙ্কা করিতেছিলেন। ললিতার কথা শুনিয়া আজ তাহার মনে হইল, আমোদপ্রমোদে সকলের সঙ্গে যোগ দিতে না পারিলে সুচরিতার এইরূপ পার্থক্যের ভাব প্রশ্রয় পাইয়া উঠিবে। পরেশবাবু ললিতাকে কহিলেন, “তোমার মাকে বলো গে।”