মাধব কহিল, “আর কিছু নয়, একবার কেবল জানিয়ে আসুক, একজন ভদ্রলোক কোথা থেকে এসে সাক্ষী ভাঙাবার জন্যে চেষ্টা করে বেড়াচ্ছে।”
ম্যাজিস্ট্রেট ব্রাউন্লো সাহেব দিবাবসানে নদীর ধারের রাস্তায় পদব্রজে বেড়াইতেছেন, সঙ্গে হারানবাবু রহিয়াছেন। কিছু দূরে গাড়িতে তাঁহার মেম পরেশবাবুর মেয়েদের লইয়া হাওয়া খাইতে বাহির হইয়াছেন।
ব্রাউন্লো সাহেব গার্ড্ন্-পার্টিতে মাঝে মাঝে বাঙালি ভদ্রলোকদিগকে তাঁহার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করিতেন। জিলার এন্ট্রেন্স স্কুলে প্রাইজ বিতরণ উপলক্ষে তিনিই সভাপতির কাজ করিতেন। কোনো সম্পন্ন লোকের বাড়িতে বিবাহাদি ক্রিয়াকর্মে তাঁহাকে আহ্বান করিলে তিনি গৃহকর্তার অভ্যর্থনা গ্রহণ করিতেন। এমন-কি, যাত্রাগানের মজলিসে আহূত হইয়া তিনি একটা বড়ো কেদারায় বসিয়া কিছুক্ষণের জন্য ধৈর্যসহকারে গান শুনিতে চেষ্টা করিতেন। তাঁহার আদালতে গবর্মেন্ট্ প্লীডারের বাড়িতে গত পূজার দিন যাত্রায় যে দুই ছোকরা ভিস্তি ও মেথরানি সাজিয়াছিল তাহাদের অভিনয়ে তিনি বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করিয়াছিলেন এবং তাঁহার অনুরোধক্রমে একাধিক বার তাহাদের অংশ তাঁহার সম্মুখে পুনরাবৃত্ত হইয়াছিল।
তাঁহার স্ত্রী মিশনরির কন্যা ছিলেন। তাঁহার বাড়িতে মাঝে মাঝে মিশনরি মেয়েদের চা-পান-সভা বসিত। জেলায় তিনি একটি মেয়ে-ইস্কুল স্থাপন করিয়াছিলেন এবং যাহাতে সে স্কুলে ছাত্রীর অভাব না হয় সেজন্য তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করিতেন। পরেশবাবুর বাড়িতে মেয়েদের মধ্যে বিদ্যাশিক্ষার চর্চা দেখিয়া তিনি তাহাদিগকে সর্বদা উৎসাহ দিতেন; দূরে থাকিলেও মাঝে মাঝে চিঠিপত্র চালাইতেন ও ক্রিস্মাসের সময় তাহাদিগকে ধর্মগ্রন্থ উপহার পাঠাইতেন।
মেলা বসিয়াছে। তদুপলক্ষে হারানবাবু সুধীর ও বিনয়ের সঙ্গে বরদাসুন্দরী ও মেয়েরা সকলেই আসিয়াছেন— তাঁহাদিগকে ইনস্পেক্শন-বাংলায় স্থান দেওয়া হইয়াছে। পরেশবাবু এই-সমস্ত গোলমালের মধ্যে কোনোমতেই থাকিতে পারেন না, এইজন্য তিনি একলা কলিকাতাতেই রহিয়া গিয়াছেন। সুচরিতা তাঁহার সঙ্গরক্ষার জন্য তাঁহার কাছে থাকিতে অনেক চেষ্টা পাইয়াছিল, কিন্তু পরেশ ম্যাজিস্ট্রেটের নিমন্ত্রণে কর্তব্যপালনের জন্য সুচরিতাকে বিশেষ উপদেশ দিয়াই পাঠাইয়া দিলেন। আগামী পরশ্ব কমিশনর সাহেব ও সস্ত্রীক ছোটোলাটের সম্মুখে ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে ডিনারের পরে ঈভ্নিং পার্টিতে পরেশবাবুর মেয়েদের দ্বারা অভিনয় আবৃত্তি প্রভৃতি হইবার কথা স্থির হইয়াছে। সেজন্য ম্যাজিস্ট্রেটের অনেক ইংরেজ বন্ধু জেলা ও কলিকাতা হইতে আহূত হইয়াছেন। কয়েকজন বাছা বাছা বাঙালি ভদ্রলোকেরও উপস্থিত হইবার আয়োজন হইয়াছে। তাঁহাদের জন্য বাগানে একটি তাঁবুতে ব্রাহ্মণ পাচক-কর্তৃক প্রস্তুত জলযোগেরও ব্যবস্থা হইবে এইরূপ শুনা যাইতেছে।
হারানবাবু অতি অল্পকালের মধ্যেই উচ্চভাবের আলাপে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে বিশেষ সন্তুষ্ট করিতে পারিয়াছিলেন। খৃস্টান ধর্মশাস্ত্রে হারানবাবুর অসামান্য অভিজ্ঞতা দেখিয়া সাহেব আশ্চর্য হইয়া গিয়াছিলেন এবং খৃস্টান ধর্ম গ্রহণে তিনি অল্প একটুমাত্র বাধা কেন রাখিয়াছেন এই প্রশ্নও হারানবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন।
আজ অপরাহ্নে নদীতীরের পথে হারানবাবুর সঙ্গে তিনি ব্রাহ্মসমাজের কার্যপ্রণালী ও হিন্দুসমাজের সংস্কারসাধন সম্বন্ধে গভীরভাবে আলোচনায় নিযুক্ত ছিলেন। এমন সময় গোরা “গুড ঈভনিং সার” বলিয়া তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।
কাল সে ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত দেখা করিবার চেষ্টা করিতে গিয়া বুঝিয়াছে যে সাহেবের চৌকাঠ উত্তীর্ণ হইতে গেলে তাঁহার পেয়াদার মাশুল জোগাইতে হয়। এরূপ দণ্ড ও অপমান স্বীকার করিতে অসম্মত হইয়া আজ সাহেবের হাওয়া খাইবার অবকাশে সে