লোকটাকে দেখিয়া সাহেব কিছু বিস্মিত হইয়া গেলেন। এমন ছয় ফুটের চেয়ে লম্বা, হাড়-মোটা, মজবুত মানুষ তিনি বাংলা দেশে পূর্বে দেখিয়াছেন বলিয়া মনে করিতে পারিলেন না। ইহার দেহের বর্ণও সাধারণ বাঙালির মতো নহে। গায়ে একখানা খাকি রঙের পাঞ্জাবি জামা, ধুতি মোটা ও মলিন, হাতে একগাছা বাঁশের লাঠি, চাদরখানাকে মাথায় পাগড়ির মতো বাঁধিয়াছে।
গোরা ম্যাজিস্ট্রেটকে কহিল, “আমি চর-ঘোষপুর হইতে আসিতেছি।”
ম্যাজিস্ট্রেট একপ্রকার বিস্ময়সূচক শিস দিলেন। ঘোষপুরের তদন্তকার্যে একজন বিদেশী বাধা দিতে আসিয়াছে সে সংবাদ তিনি গতকল্যই পাইয়াছিলেন। তবে এই লোকটাই সে! গোরাকে আপাদমস্তক তীক্ষ্ণভাবে একবার নিরীক্ষণ করিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কোন্ জাত?”
গোরা কহিল, “আমি বাঙালি ব্রাহ্মণ।”
সাহেব কহিলেন, “ও! খবরের কাগজের সঙ্গে তোমার যোগ আছে বুঝি?”
গোরা কহিল, “না।”
ম্যাজিস্ট্রেট কহিলেন, “তবে ঘোষপুর-চরে তুমি কী করতে এসেছ?”
গোরা কহিল, “ভ্রমণ করতে করতে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলুম। পুলিসের অত্যাচারে গ্রামের দুর্গতির চিহ্ন দেখে এবং আরো উপদ্রবের সম্ভাবনা আছে জেনে প্রতিকারের জন্য আপনার কাছে এসেছি।”
ম্যাজিস্ট্রেট কহিলেন, “চর-ঘোষপুরের লোকগুলো অত্যন্ত বদমায়েস সে কথা তুমি জান?”
গোরা কহিল, “তারা বদমায়েস নয়, তারা নির্ভীক, স্বাধীনচেতা— তারা অন্যায় অত্যাচার নীরবে সহ্য করতে পারে না।”
ম্যাজিস্ট্রেট চটিয়া উঠিলেন। তিনি মনে মনে ঠিক করিলেন নব্যবাঙালি ইতিহাসের পুঁথি পড়িয়া কতকগুলা বুলি শিখিয়াছে— ইন্সাফারেব্ল্!
“এখানকার অবস্থা তুমি কিছুই জান না” বলিয়া ম্যাজিস্ট্রেট গোরাকে খুব একটা ধমক দিলেন।
“আপনি এখানকার অবস্থা আমার চেয়ে অনেক কম জানেন।” গোরা মেঘমন্দ্রস্বরে জবাব করিল।
ম্যাজিস্ট্রেট কহিলেন, “আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি তুমি যদি ঘোষপুরের ব্যাপার সম্বন্ধে কোনোপ্রকার হস্তক্ষেপ কর তা হলে খুব সস্তায় নিষ্কৃতি পাবে না।”
গোরা কহিল, “আপনি যখন অত্যাচারের প্রতিবিধান করবেন না বলে মনস্থির করেছেন এবং গ্রামের লোকের বিরুদ্ধে আপনার ধারণা যখন বদ্ধমূল, তখন আমার আর-কোনো উপায় নেই— আমি গ্রামের লোকদের নিজের চেষ্টায় পুলিসের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্যে উৎসাহিত করব।”
ম্যাজিস্ট্রেট চলিতে চলিতে হঠাৎ থামিয়া দাঁড়াইয়া বিদ্যুতের মতো গোরার দিকে ফিরিয়া গর্জিয়া উঠিলেন, “কী! এত বড়ো স্পর্ধা!”
গোরা দ্বিতীয় কোনো কথা না বলিয়া ধীরগমনে চলিয়া গেল।
ম্যাজিস্ট্রেট কহিলেন, “হারানবাবু, আপনাদের দেশের লোকদের মধ্যে এ-সকল কিসের লক্ষণ দেখা যাইতেছে?”
হারানবাবু কহিলেন, “লেখাপড়া তেমন গভীরভাবে হইতেছে না, বিশেষত দেশে আধ্যাত্মিক ও চারিত্রনৈতিক শিক্ষা একেবারে নাই বলিয়াই এরূপ ঘটিতেছে। ইংরেজি বিদ্যার যেটা শ্রেষ্ঠ অংশ সেটা গ্রহণ করিবার অধিকার ইহাদের হয় নাই। ভারতবর্ষে ইংরেজের