হারানবাবু ক্রুদ্ধ হইয়া বলিতে লাগিলেন, “ললিতা, তুমি— ”
ললিতা হারানবাবুর দিক হইতে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “চুপ করুন। আপনাকে আমি কিছু বলছি নে। বিনয়বাবু, আপনি কারো অনুরোধ রাখবেন না। আজ কোনোমতেই অভিনয় হতেই পারে না।”
বরদাসুন্দরী তাড়াতাড়ি ললিতার কথা চাপা দিয়া কহিলেন, “ললিতা, তুই তো আচ্ছা মেয়ে দেখছি। বিনয়বাবুকে আজ স্নান করতে খেতে দিবি নে? বেলা দেড়টা বেজে গেছে তা জানিস? দেখ্ দেখি ওঁর মুখ শুকিয়ে কী রকম চেহারা হয়ে গেছে।”
বিনয় কহিল, “এখানে আমরা সেই ম্যাজিস্ট্রেটের অতিথি— এ বাড়িতে আমি স্নানাহার করতে পারব না।”
বরদাসুন্দরী বিনয়কে বিস্তর মিনতি করিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন। মেয়েরা সকলেই চুপ করিয়া আছে দেখিয়া তিনি রাগিয়া বলিলেন, “তোদের সব হল কী? সুচি, তুমি বিনয়বাবুকে একটু বুঝিয়ে বলো-না। আমরা কথা দিয়েছি— লোকজন সব ডাকা হয়েছে, আজকের দিনটা কোনোমতে কাটিয়ে যেতে হবে— নইলে ওরা কী মনে করবে বলো দেখি! আর যে ওদের সামনে মুখ দেখাতে পারব না।”
সুচরিতা চুপ করিয়া মুখ নিচু করিয়া বসিয়া রহিল।
বিনয় অদূরে নদীতে স্টীমারে চলিয়া গেল। এই স্টীমার আজ ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই যাত্রী লইয়া কলিকাতায় রওনা হইবে— আগামী কাল আটটা আন্দাজ সময়ে সেখানে পৌঁছিবে।
হারানবাবু উত্তেজিত হইয়া উঠিয়া বিনয় ও গোরাকে নিন্দা করিতে আরম্ভ করিলেন। সুচরিতা তাড়াতাড়ি চৌকি হইতে উঠিয়া পাশের ঘরে প্রবেশ করিয়া বেগে দ্বার ভেজাইয়া দিল। একটু পরেই ললিতা দ্বার ঠেলিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। দেখিল, সুচরিতা দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া বিছানার উপর পড়িয়া আছে।
ললিতা ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়া ধীরে ধীরে সুচরিতার পাশে বসিয়া তাহার মাথায় চুলের মধ্যে আঙুল বুলাইয়া দিতে লাগিল। অনেকক্ষণ পরে সুচরিতা যখন শান্ত হইল তখন জোর করিয়া তাহার মুখ হইতে বাহুর আবরণ মুক্ত করিয়া তাহার মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া কানে কানে বলিতে লাগিল, “দিদি, আমরা এখান থেকে কলকাতায় ফিরে যাই, আজ তো ম্যাজিস্ট্রেটের ওখানে যেতে পারব না।”
সুচরিতা অনেকক্ষণ এ কথার কোনো উত্তর করিল না। ললিতা যখন বার বার বলিতে লাগিল তখন সে বিছানায় উঠিয়া বসিল, “সে কী করে হবে ভাই? আমার তো একেবারেই আসবার ইচ্ছা ছিল না— বাবা যখন পাঠিয়ে দিয়েছেন তখন যেজন্যে এসেছি তা না সেরে যেতে পারব না।”
ললিতা কহিল, “বাবা তো এ-সব কথা জানেন না— জানলে কখনোই আমাদের থাকতে বলতেন না।”
সুচরিতা কহিল, “তা কি করে জানব ভাই!”
ললিতা। দিদি, তুই পারবি? কী করে যাবি বল্ দেখি! তার পরে আবার সাজগোজ করে স্টেজে দাঁড়িয়ে কবিতা আওড়াতে হবে। আমার তো জিব ফেটে গিয়ে রক্ত পড়বে তবু কথা বের হবে না।
সুচরিতা কহিল, “সে তো জানি বোন! কিন্তু নরকযন্ত্রণাও সইতে হয়। এখন আর কোনো উপায় নেই। আজকের দিন জীবনে আর কখনো ভুলতে পারব না।”
সুচরিতার এই বাধ্যতায় ললিতা রাগ করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল। মাকে আসিয়া কহিল, “মা, তোমরা যাবে না?”
বরদাসুন্দরী কহিলেন, “তুই কি পাগল হয়েছিস? রাত্তির নটার পর যেতে হবে।”
ললিতা কহিল, “আমি কলকাতায় যাবার কথা বলছি।”