ললিতাকে সঙ্গে লইয়া বিনয় পরেশবাবুর বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল।
ললিতার সম্বন্ধে বিনয়ের মনের ভাবটা কী তাহা স্টীমারে উঠিবার পূর্বে পর্যন্ত বিনয় নিশ্চিত জানিত না। ললিতার সঙ্গে বিরোধেই তাহার মন ব্যাপৃত ছিল। কেমন করিয়া এই দুর্বশ মেয়েটির সঙ্গে কোনোমতে সন্ধিস্থাপন হইতে পারে কিছুকাল হইতে ইহাই তাহার প্রায় প্রতিদিনের চিন্তার বিষয় ছিল। বিনয়ের জীবনে স্ত্রীমাধুর্যের নির্মল দীপ্তি লইয়া সুচরিতাই প্রথম সন্ধ্যাতারাটির মতো উদিত হইয়াছিল। এই আবির্ভাবের অপরূপ আনন্দে বিনয়ের প্রকৃতিকে পরিপূর্ণতা দান করিয়া আছে, ইহাই বিনয় মনে মনে জানিত। কিন্তু ইতিমধ্যে আরো যে তারা উঠিয়াছে এবং জ্যোতিরুৎসবের ভূমিকা করিয়া দিয়া প্রথম তারাটি যে কখন ধীরে ধীরে দিগন্তরালে অবতরণ করিতেছিল বিনয় তাহা স্পষ্ট করিয়া বুঝিতে পারে নাই।
বিদ্রোহী ললিতা যেদিন স্টীমারে উঠিয়া আসিল সেদিন বিনয়ের মনে হইল, ললিতা এবং আমি একপক্ষ হইয়া সমস্ত সংসারের প্রতিকূলে যেন খাড়া হইয়াছি। এই ঘটনায় ললিতা আর-সকলকে ছাড়িয়া তাহারই পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে এ কথা বিনয় কিছুতেই ভুলিতে পারিল না। যে-কোনো কারণে যেকোনো উপলক্ষেই হউক, ললিতার পক্ষে বিনয় আজ অনেকের মধ্যে একজনমাত্র নহে— ললিতার পার্শ্বে সেই একাকী, সেই একমাত্র; সমস্ত আত্মীয়-স্বজন দূরে, সেই নিকটে। এই নৈকট্যের পুলকপূর্ণ স্পন্দন বিদ্যুদ্গর্ভ মেঘের মতো তাহার বুকের মধ্যে গুরুগুরু করিতে লাগিল। প্রথম শ্রেণীর ক্যাবিনে ললিতা যখন ঘুমাইতে গেল তখন বিনয় তাহার স্বস্থানে শুইতে যাইতে পারিল না— সেই ক্যাবিনের বাহিরে ডেকে সে জুতা খুলিয়া নিঃশব্দে পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিল। স্টীমারে ললিতার প্রতি কোনো উৎপাত ঘটিবার বিশেষ সম্ভাবনা ছিল না, কিন্তু বিনয় তাহার অকস্মাৎ নূতনলব্ধ অধিকারটিকে পুরা অনুভব করিবার প্রলোভন অপ্রয়োজনেও না খাটাইয়া থাকিতে পারিল না।
রাত্রি গভীর অন্ধকারময়, মেঘশূন্য নভস্তল তারায় আচ্ছন্ন, তীরে তরুশ্রেণী নিশীথ আকাশের কালিমাঘন নিবিড় ভিত্তির মতো স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে, নিম্নে প্রশস্ত নদীর প্রবল ধারা নিঃশব্দে চলিয়াছে, ইহার মাঝখানে ললিতা নিদ্রিত। আর কিছু নয়, এই সুন্দর, এই বিশ্বাসপূর্ণ নিদ্রাটুকুকে ললিতা আজ বিনয়ের হাতে সমর্পণ করিয়া দিয়াছে। এই নিদ্রাটুকুকে বিনয় মহামূল্য রত্নটির মতো রক্ষা করিবার ভার লইয়াছে। পিতামাতা ভাইভগিনী কেহই নাই, একটি অপরিচিত শয্যার উপর ললিতা আপন সুন্দর দেহখানি রাখিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া ঘুমাইতেছে— নিশ্বাসপ্রশ্বাস যেন এই নিদ্রাকাব্যটুকুর ছন্দ পরিমাপ করিয়া অতি শান্তভাবে গতায়াত করিতেছে, সেই নিপুণ কবরীর একটি বেণীও বিস্রস্ত হয় নাই, সেই নারীহৃদয়ের কল্যাণকোমলতায় মণ্ডিত হাত দুইখানি পরিপূর্ণ বিরামে বিছানার উপরে পড়িয়া আছে, কুসুমসুকুমার দুইটি পদতল তাহার সমস্ত রমণীয় গতিচেষ্টাকে উৎসব-অবসানের সংগীতের মতো স্তব্ধ করিয়া বিছানার উপর মেলিয়া রাখিয়াছে— বিশ্রব্ধ বিশ্রামের এই ছবিখানি বিনয়ের কল্পনাকে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল। শুক্তির মধ্যে মুক্তাটুকু যেমন, গ্রহতারামণ্ডিত নিঃশব্দতিমিরবেষ্টিত এই আকাশমণ্ডলের মাঝখানটিতে ললিতার এই নিদ্রাটুকু, এই সুডোল সুন্দর সম্পূর্ণ বিশ্রামটুকু জগতে তেমনি একটিমাত্র ঐশ্বর্য বলিয়া আজ বিনয়ের কাছে প্রতিভাত হইল। ‘আমি জাগিয়া আছি’ ‘আমি জাগিয়া আছি’— এই বাক্য বিনয়ের বিস্ফারিত বক্ষঃকুহর হইতে অভয়শঙ্খধ্বনির মতো উঠিয়া মহাকাশের অনিমেষ জাগ্রত পুরুষের নিঃশব্দবাণীর সহিত মিলিত হইল।
এই কৃষ্ণপক্ষের রাত্রিতে আরো একটা কথা কেবলই বিনয়কে আঘাত করিতেছিল—আজ রাত্রে গোরা জেলখানায়! আজ পর্যন্ত বিনয় গোরার সকল সুখ-দুঃখেই ভাগ লইয়া আসিয়াছে, এইবার প্রথম তাহার অন্যথা ঘটিল। বিনয় জানিত গোরার মতো মানুষের পক্ষে জেলের শাসন কিছুই নহে, কিন্তু প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত এই ব্যাপারে বিনয়ের সঙ্গে গোরার কোনো যোগ ছিল না— গোরার