মন বশ করিতে বিনয়ের বিলম্ব হইত না। এই প্রিয়দর্শন প্রিয়ভাষী যুবক দেখিতে দেখিতে মাসিমার মনে সতীশের সঙ্গে দখল ভাগ করিয়া লইল।
মাসিমা জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাছা, তোমার মা কোথায়?”
বিনয় কহিল, “আমার নিজের মাকে অনেক দিন হল হারিয়েছি, কিন্তু আমার মা নেই এমন কথা আমি মুখে আনতে পারব না।”
এই বলিয়া আনন্দময়ীর কথা স্মরণ করিবা মাত্র তাহার দুই চক্ষু যেন ভাবের বাষ্পে আর্দ্র হইয়া আসিল।
দুই পক্ষে কথা খুব জমিয়া উঠিল। ইহাদের মধ্যে আজ যে নূতন পরিচয় সে কথা কিছুতেই মনে হইল না। সতীশ এই কথাবার্তার মাঝখানে নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে মন্তব্য প্রকাশ করিতে লাগিল এবং ললিতা চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
চেষ্টা করিলেও ললিতা নিজেকে সহজে যেন বাহির করিতে পারে না। প্রথম পরিচয়ের বাধা ভাঙিতে তাহার অনেক সময় লাগে। তা ছাড়া, আজ তাহার মন ভালো ছিল না। বিনয় যে অনায়াসেই এই অপরিচিতার সঙ্গে আলাপ জুড়িয়া দিল ইহা তাহার ভালো লাগিতেছিল না; ললিতার যে সংকট উপস্থিত হইয়াছে বিনয় তাহার গুরুত্ব মনের মধ্যে গ্রহণ না করিয়া যে এমন নিরুদ্বিগ্ন হইয়া আছে ইহাতে বিনয়কে লঘুচিত্ত বলিয়া সে মনে মনে অপবাদ দিল। কিন্তু মুখ গম্ভীর করিয়া বিষণ্নভাবে চুপচাপ বসিয়া থাকিলেই বিনয় যে ললিতার অসন্তোষ হইতে নিষ্কৃতি পাইত তাহা নহে; তাহা হইলে নিশ্চয় ললিতা রাগিয়া মনে মনে এই কথা বলিত, ‘আমার সঙ্গেই বাবার বোঝাপড়া, কিন্তু বিনয়বাবু এমন ভাব ধারণ করিতেছেন কেন, যেন উহার ঘাড়েই এই দায় পড়িয়াছে!’ আসল কথা, কাল রাত্রে যে আঘাতে সংগীত বাজিয়াছিল আজ দিনের বেলায় তাহাতে ব্যথাই বাজিতেছে— কিছুই ঠিকমত হইতেছে না। আজ তাই ললিতা প্রতি পদে বিনয়ের সঙ্গে মনে মনে ঝগড়াই করিতেছে; বিনয়ের কোনো ব্যবহারেই এ ঝগড়া মিটিতে পারিত না— কোন্ মূলে সংশোধন হইলে ইহার প্রতিকার হইতে পারিত তাহা অন্তর্যামীই জানেন।
হায় রে, হৃদয় লইয়াই যাহাদের কারবার সেই মেয়েদের ব্যবহারকে যুক্তিবিরুদ্ধ বলিয়া দোষ দিলে চলিবে কেন? যদি গোড়ায় ঠিক জায়গাটিতে ইহার প্রতিষ্ঠা থাকে তবে হৃদয় এমনি সহজে এমনি সুন্দর চলে যে, যুক্তিতর্ক হার মানিয়া মাথা হেঁট করিয়া থাকে, কিন্তু সেই গোড়ায় যদি লেশমাত্র বিপর্যয় ঘটে তবে বুদ্ধির সাধ্য কী যে কল ঠিক করিয়া দেয়— তখন রাগবিরাগ হাসিকান্না, কী হইতে যে কী ঘটে তাহার হিসাব তলব করিতে যাওয়াই বৃথা।
এ দিকে বিনয়ের হৃদয়যন্ত্রটিও যে বেশ স্বাভাবিকভাবে চলিতেছিল তাহা নহে। তাহার অবস্থা যদি অবিকল পূর্বের মতো থাকিত তবে এই মুহূর্তেই সে ছুটিয়া আনন্দময়ীর কাছে যাইত। গোরার কারাদণ্ডের খবর বিনয় ছাড়া মাকে আর কে দিতে পারে! সে ছাড়া মায়ের সান্ত্বনাই বা আর কে আছে! এই বেদনার কথাটা বিনয়ের মনের তলায় বিষম একটা ভার হইয়া তাহাকে কেবলই পেষণ করিতেছিল— কিন্তু ললিতাকে এখনই ছাড়িয়া চলিয়া যায় ইহা তাহার পক্ষে অসম্ভব হইয়াছিল। সমস্ত সংসারের বিরুদ্ধে আজ সেই যে ললিতার রক্ষক, ললিতা সম্বন্ধে পরেশবাবুর কাছে তাহার যদি কিছু কর্তব্য থাকে তাহা শেষ করিয়া তাহাকে যাইতে হইবে এই কথা সে মনকে বুঝাইতেছিল। মন তাহা অতি সামান্য চেষ্টাতেই বুঝিয়া লইতেছিল; তাহার প্রতিবাদ করিবার ক্ষমতাই ছিল না। গোরা এবং আনন্দময়ীর জন্য বিনয়ের মনে যত বেদনাই থাক্, আজ ললিতার অতিসন্নিকট অস্তিত্ব তাহাকে এমন আনন্দ দিতে লাগিল— এমন একটা বিস্ফারতা, সমস্ত সংসারের মধ্যে এমন একটা বিশেষ গৌরব, নিজের সত্তার এমন একটা বিশিষ্ট স্বাতন্ত্র্য অনুভব করিতে লাগিল যে তাহার মনের বেদনাটা মনের নীচের তলাতেই রহিয়া গেল। ললিতার দিকে সে আজ চাহিতে পারিতেছিল না— কেবল ক্ষণে ক্ষণে চোখে আপনি যেটুকু পড়িতেছিল, ললিতার কাপড়ের একটুকু অংশ, কোলের উপর নিশ্চলভাবে স্থিত তাহার একখানি হাত— মুহূর্তের মধ্যে ইহাই তাহাকে পুলকিত করিতে লাগিল।