পূর্বে এমন এক সময় ছিল যখন ললিতার সম্বন্ধে বিনয়ের মনে কোনোপ্রকার সংকোচ ছিল না। সেই মোহমুক্ত অবস্থায় সে যে আনন্দময়ীর কাছে ললিতার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি লইয়া অবাধে আলোচনা করিয়াছিল সে কথা তাহার মনেই ছিল না।
আনন্দময়ী সুনিপুণ মাঝির মতো সমস্ত বাধা বাঁচাইয়া ললিতার কথা এমন করিয়া চালনা করিয়া লইয়া গেলেন যে বিনয়ের সঙ্গে তাহার পরিচয়ের ইতিহাসের প্রধান অংশগুলি প্রায় সমস্তই প্রকাশ হইল। গোরার কারাদণ্ডের ব্যাপারে ব্যথিত হইয়া ললিতা যে স্টীমারে একাকিনী বিনয়ের সঙ্গে পলাইয়া আসিয়াছে, সে কথাও বিনয় আজ বলিয়া ফেলিল। বলিতে বলিতে তাহার উৎসাহ বাড়িয়া উঠিল— যে অবসাদে সন্ধ্যাবেলায় তাহাকে চাপিয়া ধরিয়াছিল তাহা কোথায় কাটিয়া গেল। সে যে ললিতার মতো এমন একটি আশ্চর্য চরিত্রকে জানিয়াছে এবং এমন করিয়া তাহার কথা কহিতে পারিতেছে ইহাই তাহার কাছে একটা পরম লাভ বলিয়া মনে হইতে লাগিল। রাত্রে যখন আহারের সংবাদ আসিল এবং কথা ভাঙিয়া গেল তখন হঠাৎ যেন স্বপ্ন হইতে জাগিয়া বিনয় বুঝিতে পারিল তাহার মনে যাহা-কিছু কথা ছিল আনন্দময়ীর কাছে তাহা সমস্তই বলা হইয়া গেছে। আনন্দময়ী এমন করিয়া সমস্ত শুনিলেন, এমন করিয়া সমস্ত গ্রহণ করিলেন যে, ইহার মধ্যে যে কিছু লজ্জা করিবার আছে তাহা বিনয়ের মনেই হইল না। আজ পর্যন্ত মা’র কাছে লুকাইবার কথা বিনয়ের কিছুই ছিল না— অতি তুচ্ছ কথাটিও সে তাঁহার কাছে আসিয়া বলিত। কিন্তু পরেশবাবুর পরিবারের সঙ্গে আলাপ হইয়া অবধি কোথায় একটা বাধা পড়িয়াছিল। সেই বাধা বিনয়ের পক্ষে স্বাস্থ্যকর হয় নাই। আজ ললিতার সম্বন্ধে তাহার মনের কথা সূক্ষ্মদর্শিনী আনন্দময়ীর কাছে একরকম করিয়া সমস্ত প্রকাশ হইয়া গেছে তাহা অনুভব করিয়া বিনয় উল্লসিত হইয়া উঠিল। মাতার কাছে তাহার জীবনের এই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ নিবেদন করিতে না পারিলে কথাটা কোনোমতেই নির্মল হইয়া উঠিত না— ইহা তাহার চিন্তার মধ্যে কালির দাগ দিতে থাকিত।
রাত্রে আনন্দময়ী অনেকক্ষণ এই কথা লইয়া মনে মনে আলোচনা করিয়াছিলেন। গোরার জীবনের যে সমস্যা উত্তরোত্তর জটিল হইয়া উঠিতেছিল পরেশবাবুর ঘরেই তাহার একটা মীমাংসা ঘটিতে পারে এই কথা মনে করিয়া তিনি ভাবিতে লাগিলেন, যেমন করিয়া হউক, মেয়েদের সঙ্গে একবার দেখা করিতে হইবে।
শশিমুখীর সঙ্গে বিনয়ের বিবাহ যেন একপ্রকার স্থির হইয়া গেছে এইভাবে মহিম এবং তাঁহার ঘরের লোকেরা চলিতেছিলেন। শশিমুখী তো বিনয়ের কাছেও আসিত না। শশিমুখীর মা’র সঙ্গে বিনয়ের পরিচয় ছিল না বলিলেই হয়। তিনি যে ঠিক লাজুক ছিলেন তাহা নহে, কিন্তু অস্বাভাবিক রকমের গোপনচারিণী ছিলেন। তাঁহার ঘরের দরজা প্রায়ই বন্ধ। স্বামী ছাড়া তাঁহার আর সমস্তই তালাচাবির মধ্যে। স্বামীও যে যথেষ্ট খোলা পাইতেন তাহা নহে— স্ত্রীর শাসনে তাঁহার গতিবিধি অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং তাঁহার সঞ্চরণক্ষেত্রের পরিধি নিতান্ত সংকীর্ণ ছিল। এইরূপ ঘের দিয়া লওয়ার স্বভাব-বশত শশিমুখীর মা লক্ষ্মীমণির জগৎটি সম্পূর্ণ তাঁহার আয়ত্তের মধ্যে ছিল— সেখানে বাহিরের লোকের ভিতরে এবং ভিতরের লোকের বাহিরে যাওয়ার পথ অবারিত ছিল না। এমন-কি, গোরাও লক্ষ্মীমণির মহলে তেমন করিয়া আমল পাইত না। এই রাজ্যের বিধিব্যবস্থার মধ্যে কোনো দ্বৈধ ছিল না। কারণ, এখানকার বিধানকর্তাও লক্ষ্মীমণি এবং নিম্ন-আদালত হইতে আপিল-আদালত পর্যন্ত সমস্তই লক্ষ্মীমণি— এক্জিক্যুটিভ এবং জুডিশিয়ালে তো ভেদ ছিলই না, লেজিস্লেটিভও তাহার সহিত জোড়া ছিল। বাহিরের লোকের সঙ্গে ব্যবহারে মহিমকে খুব শক্ত লোক বলিয়াই মনে হইত, কিন্তু লক্ষ্মীমণির এলাকার মধ্যে তাঁহার নিজের ইচ্ছা খাটাইবার কোনো পথ ছিল না। সামান্য বিষয়েও না।
লক্ষ্মীমণি বিনয়কে আড়াল হইতে দেখিয়াছিলেন, পছন্দও করিয়াছিলেন। মহিম বিনয়ের বাল্যকাল হইতে গোরার বন্ধুরূপে