আনন্দময়ী ললিতার মুখের দিকে চাহিলেন; সে খুব জোর করিয়া চোখ তুলিয়া রাখিল বটে, কিন্তু বৃথা লাল হইয়া উঠিল।
আনন্দময়ী কহিলেন,“তোমার বাবার জন্যে ও কত লোকের সঙ্গে ঝগড়া করেছে! ওর দলের লোকেরা তো ওকে ব্রাহ্ম বলে জাতে ঠেলবার জো করেছে। বিনু, অমন অস্থির হয়ে উঠলে চলবে না বাছা— সত্যি কথাই বলছি। এতে লজ্জা করবারও তো কোনো কারণ দেখি নে। কী বল মা?”
এবার ললিতার মুখের দিকে চাহিতেই তাহার চোখ নামিয়া পড়িল। সুচরিতা কহিল, “বিনয়বাবু যে আমাদের আপনার লোক বলে জানেন সে আমরা খুব জানি— কিন্তু সে যে কেবল আমাদেরই গুণে তা নয়, সে ওর নিজের ক্ষমতা।”
আনন্দময়ী কহিলেন,“তা ঠিক বলতে পারি নে মা! ওকে তো এতটুকুবেলা থেকে দেখছি, এতদিন ওর বন্ধুর মধ্যে এক আমার গোরাই ছিল; এমন-কি, আমি দেখেছি ওদের নিজের দলের লোকের সঙ্গেও বিনয় মিলতে পারে না। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে ওর দুদিনের আলাপে এমন হয়েছে যে আমরাও ওর আর নাগাল পাই নে। ভেবেছিলুম এই নিয়ে তোমাদের সঙ্গে ঝগড়া করব, কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি আমাকেও ওরই দলে ভিড়তে হবে। তোমরা সক্কলকেই হার মানাবে।”
এই বলিয়া আনন্দময়ী একবার ললিতার ও একবার সুচরিতার চিবুক স্পর্শ করিয়া অঙ্গুলিদ্বারা চুম্বন গ্রহণ করিলেন।
সুচরিতা বিনয়ের দুরবস্থা লক্ষ্য করিয়া সদয়চিত্তে কহিল, “বিনয়বাবু, বাবা এসেছেন; তিনি বাইরে কৃষ্ণদয়ালবাবুর সঙ্গে কথা কচ্ছেন।”
শুনিয়া বিনয় তাড়াতাড়ি বাহিরে চলিয়া গেল। তখন গোরা ও বিনয়ের অসামান্য বন্ধুত্ব লইয়া আনন্দময়ী আলোচনা করিতে লাগিলেন। শ্রোতা দুইজনে যে উদাসীন নহে তাহা বুঝিতে তাঁহার বাকি ছিল না। আনন্দময়ী জীবনে এই দুটি ছেলেকেই তাঁহার মাতৃস্নেহের পরিপূর্ণ অর্ঘ্য দিয়া পূজা করিয়া আসিয়াছেন, সংসারে ইহাদের চেয়ে বড়ো তাঁহার আর কেহ ছিল না। বালিকার পূজার শিবের মতো ইহাদিগকে তিনি নিজের হাতেই গড়িয়াছেন বটে, কিন্তু ইহারাই তাঁহার সমস্ত আরাধনা গ্রহণ করিয়াছে। তাঁহার মুখে তাঁহার এই দুটি ক্রোড়দেবতার কাহিনী স্নেহরসে এমন মধুর উজ্জ্বল হইয়া উঠিল যে সুচরিতা এবং ললিতা অতৃপ্তহৃদয়ে শুনিতে লাগিল। গোরা এবং বিনয়ের প্রতি তাহাদের শ্রদ্ধার অভাব ছিল না, কিন্তু আনন্দময়ীর মতো এমন মায়ের এমন স্নেহের ভিতর দিয়া তাহাদের সঙ্গে যেন আর-একটু বিশেষ করিয়া, নূতন করিয়া পরিচয় হইল।
আনন্দময়ীর সঙ্গে আজ জানাশুনা হইয়া ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি ললিতার রাগ আরো যেন বাড়িয়া উঠিল। ললিতার মুখে উষ্ণবাক্য শুনিয়া আনন্দময়ী হাসিলেন। কহিলেন, “মা, গোরা আজ জেলখানায়, এ দুঃখ যে আমাকে কী রকম বেজেছে তা অন্তর্যামীই জানেন। কিন্তু সাহেবের উপর আমি রাগ করতে পারি নি। আমি তো গোরাকে জানি, সে যেটাকে ভালো বোঝে তার কাছে আইনকানুন কিছুই মানে না; যদি না মানে তবে যারা বিচারকর্তা তারা তো জেলে পাঠাবেই— তাতে তাদের দোষ দিতে যাবে কেন? গোরার কাজ গোরা করেছে— ওদের কর্তব্য ওরা করেছে— এতে যাদের দুঃখ পাবার তারা দুঃখ পাবেই। আমার গোরার চিঠি যদি পড়ে দেখ, মা, তা হলে বুঝতে পারবে ও দুঃখকে ভয় করে নি, কারো উপর মিথ্যে রাগও করে নি— যাতে যা ফল হয় তা সমস্ত নিশ্চয় জেনেই কাজ করেছে।”
এই বলিয়া গোরার সযত্নরক্ষিত চিঠিখানি বাক্স হইতে বাহির করিয়া সুচরিতার হাতে দিলেন। কহিলেন, “মা, তুমি চেঁচিয়ে পড়ো, আমি আর-এক বার শুনি।”
গোরার সেই আশ্চর্য চিঠিখানি পড়া হইয়া গেলে পর তিনজনেই কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। আনন্দময়ী তাঁহার চোখের প্রান্ত আঁচল দিয়া মুছিলেন। সে যে চোখের জল তাহাতে শুধু মাতৃহৃদয়ের ব্যথা নহে, তাহার সঙ্গে আনন্দ এবং গৌরব মিশিয়া ছিল। তাঁহার গোরা কি যে-সে গোরা! ম্যাজিস্ট্রেট তাহার কসুর মাপ করিয়া তাহাকে দয়া করিয়া ছাড়িয়া দিবেন, সে কি তেমনি গোরা!