সেই সুচরিতার শোচনীয় পতনে নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে তাঁহার গর্ব কিছুমাত্র হ্রাস হইল না, তিনি সমস্ত দোষ চাপাইলেন পরেশবাবুর স্কন্ধে। পরেশবাবুকে লোকে বরাবর প্রশংসা করিয়া আসিয়াছে, কিন্তু হারানবাবু কখনো তাহাতে যোগ দেন নাই; ইহাতেও তাঁহার কতদূর প্রাজ্ঞতা প্রকাশ পাইয়াছে তাহা এইবার সকলে বুঝিতে পারিবে এইরূপ তিনি আশা করিতেছেন।
হারানবাবুর মতো লোক আর-সকলই সহ্য করিতে পারেন, কিন্তু যাহাদিগকে বিশেষরূপে হিতপথে চালাইতে চেষ্টা করেন তাহারা যদি নিজের বুদ্ধি অনুসারে স্বতন্ত্র পথ অবলম্বন করে তবে সে অপরাধ তিনি কোনোমতেই ক্ষমা করিতে পারেন না। সহজে তাহাদিগকে ছাড়িয়া দেওয়া তাঁহার পক্ষে অসাধ্য; যতই দেখেন তাঁহার উপদেশে ফল হইতেছে না ততই তাঁহার জেদ বাড়িয়া যাইতে থাকে; তিনি ফিরিয়া ফিরিয়া বারংবার আক্রমণ করিতে থাকেন। কল যেমন দম না ফুরাইলে থামিতে পারে না তিনিও তেমনি কোনোমতেই নিজেকে সংবরণ করিতে পারেন না; বিমুখ কর্ণের কাছে এক কথা সহস্র বার আবৃত্তি করিয়াও হার মানিতে চাহেন না।
ইহাতে সুচরিতা বড়ো কষ্ট পাইতে লাগিল— নিজের জন্য নহে, পরেশবাবুর জন্য। পরেশবাবু যে ব্রাহ্মসমাজের সকলের সমালোচনার বিষয় হইয়া উঠিয়াছেন এই অশান্তি নিবারণ করা যাইবে কী উপায়ে? অপর পক্ষে সুচরিতার মাসিও প্রতিদিন বুঝিতে পারিতেছিলেন যে, তিনি একান্ত নম্র হইয়া নিজেকে যতই আড়ালে রাখিবার চেষ্টা করিতেছেন ততই এই পরিবারের পক্ষে উপদ্রবস্বরূপ হইয়া উঠিতেছেন। এজন্য তাহার মাসির অত্যন্ত লজ্জা ও সংকোচ সুচরিতাকে প্রত্যহ দগ্ধ করিতে লাগিল। এই সংকট হইতে উদ্ধারের যে পথ কোথায় তাহা সুচরিতা কোনোমতেই ভাবিয়া পাইল না।
এ দিকে সুচরিতার শীঘ্র বিবাহ দিয়া ফেলিবার জন্য বরদাসুন্দরী পরেশবাবুকে অত্যন্ত পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। তিনি কহিলেন, “সুচরিতার দায়িত্ব আর আমাদের বহন করা চলে না, সে এখন নিজের মতে চলতে আরম্ভ করেছে। তার বিবাহের যদি দেরি থাকে তা হলে মেয়েদের নিয়ে আমি অন্য কোথাও যাব— সুচরিতার অদ্ভুত দৃষ্টান্ত মেয়েদের পক্ষে বড়োই অনিষ্টের কারণ হচ্ছে। দেখো এর জন্যে পরে তোমাকে অনুতাপ করতে হবেই। ললিতা আগে তো এরকম ছিল না; এখন ও যে আপন ইচ্ছামত যা খুশি একটা কাণ্ড করে বসে, কাকেও মানে না, তার মূলে কে? সেদিন যে ব্যাপারটা বাধিয়ে বসল, যার জন্যে আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি, তুমি কি মনে কর তার মধ্যে সুচরিতার কোনো হাত ছিল না? তুমি নিজের মেয়ের চেয়ে সুচরিতাকে বরাবর বেশি ভালোবাস তাতে আমি কোনোদিন কোনো কথা বলি নি, কিন্তু আর চলে না, সে আমি স্পষ্টই বলে রাখছি।”
সুচরিতার জন্য নহে, কিন্তু পারিবারিক অশান্তির জন্য পরেশবাবু চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছিলেন। বরদাসুন্দরী যে উপলক্ষটি পাইয়া বসিয়াছেন ইহা লইয়া তিনি যে হুলস্থূল কাণ্ড বাধাইয়া বসিবেন এবং যতই দেখিবেন, আন্দোলনে কোনো ফল হইতেছে না ততই দুর্বার হইয়া উঠিতে থাকিবেন, ইহাতে তাঁহার কোনো সন্দেহ ছিল না। যদি সুচরিতার বিবাহ সত্বর সম্ভবপর হয় তবে বর্তমান অবস্থায় সুচরিতার পক্ষেও তাহা শান্তিজনক হইতে পারে তাহাতে সন্দেহ নাই। তিনি বরদাসুন্দরীকে বলিলেন, “পানুবাবু যদি সুচরিতাকে সম্মত করতে পারেন তা হলে আমি বিবাহ সম্বন্ধে কোনো আপত্তি করব না।”
বরদাসুন্দরী কহিলেন, “আবার কতবার করে সম্মত করতে হবে? তুমি তো অবাক করলে! এত সাধাসাধিই বা কেন? পানুবাবুর মতো পাত্র উনি পাবেন কোথায় তাই জিজ্ঞাসা করি। তুমি রাগ কর আর যাই কর সত্যি কথা বলতে কি, সুচরিতা পানুবাবুর যোগ্য মেয়ে নয়।”
পরেশবাবু কহিলেন, “পানুবাবুর প্রতি সুচরিতার মনের ভাব যে কী তা আমি স্পষ্ট করে বুঝতে পারি নি। অতএব তারা