ললিতা কহিল, “মানুষকে বুঝতে সময় লাগে, আপনার সম্বন্ধেও হয়তো সে কথা খাটে।”
হারানবাবু কহিলেন, “প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত আমার কথার বা মতের বা ব্যবহারের কোনো ব্যত্যয় ঘটে নি— আমি আমাকে ভুল বোঝবার কোনো উপলক্ষ কাউকে দিই নি এ কথা আমি জোরের সঙ্গে বলতে পারি— সুচরিতাই বলুন আমি ঠিক বলছি কি না।”
ললিতা আবার কী একটা উত্তর দিতে যাইতেছিল— সুচরিতা তাহাকে থামাইয়া দিয়া কহিল, “আপনি ঠিক বলেছেন। আপনাকে আমি কোনো দোষ দিতে চাই নে।”
হারানবাবু কহিলেন, “দোষ যদি না দেবে তবে আমার প্রতি অন্যায়ই বা করবে কেন?”
সুচরিতা দৃঢ়স্বরে কহিল, “যদি একে অন্যায় বলেন তবে আমি অন্যায়ই করব— কিন্তু— ”
বাহির হইতে ডাক আসিল, “দিদি, ঘরে আছেন?”
সুচরিতা উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়া তাড়াতাড়ি কহিল, “আসুন, বিনয়বাবু, আসুন।”
“ভুল করছেন দিদি, বিনয়বাবু আসেন নি, আমি বিনয় মাত্র, আমাকে সমাদর করে লজ্জা দেবেন না”— বলিয়া বিনয় ঘরে প্রবেশ করিয়াই হারানবাবুকে দেখিতে পাইল। হারানবাবুর মুখের অপ্রসন্নতা লক্ষ্য করিয়া কহিল, “অনেক দিন আসি নি বলে রাগ করেছেন বুঝি!”
হারানবাবু পরিহাসে যোগ দিবার চেষ্টা করিয়া কহিলেন, “রাগ করবারই কথা বটে। কিন্তু আজ আপনি একটু অসময়ে এসেছেন— সুচরিতার সঙ্গে আমার একটা বিশেষ কথা হচ্ছিল।”
বিনয় শশব্যস্ত হইয়া উঠিল; কহিল, “ঐ দেখুন, আমি কখন এলে যে অসময়ে আসা হয় না তা আমি আজ পর্যন্ত বুঝতেই পারলুম না! এইজন্যই আসতে সাহসই হয় না।”
বলিয়া বিনয় বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিল।
সুচরিতা কহিল, “বিনয়বাবু, যাবেন না। আমাদের যা কথা ছিল শেষ হয়ে গেছে। আপনি বসুন।”
বিনয় বুঝিতে পারিল সে আসাতে সুচরিতা একটা বিশেষ সংকট হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছে। খুশি হইয়া একটা চৌকিতে বসিয়া পড়িল এবং কহিল, “আমাকে প্রশ্রয় দিলে আমি কিছুতেই সামলাতে পারি নে। আমাকে বসতে বললে আমি বসবই এইরকম আমার স্বভাব। অতএব, দিদির প্রতি নিবেদন এই যে, এ-সব কথা যেন বুঝে-সুঝে বলেন, নইলে বিপদে পড়বেন।”
হারানবাবু কোনো কথা না বলিয়া আসন্ন ঝড়ের মতো স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। তিনি নীরবে প্রকাশ করিলেন— ‘আচ্ছা বেশ, আমি অপেক্ষা করিয়া বসিয়া রহিলাম, আমার যা কথা আছে তাহা শেষ পর্যন্ত বলিয়া তবে আমি উঠিব।’
দ্বারের বাহির হইতে বিনয়ের কণ্ঠস্বর শুনিয়াই ললিতার বুকের ভিতরকার সমস্ত রক্ত যেন চমক খাইয়া উঠিয়াছিল। সে বহুকষ্টে আপনার স্বাভাবিক ভাব রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু কিছুতেই পারিল না। বিনয় যখন ঘরে প্রবেশ করিল ললিতা বেশ সহজে তাহাদের পরিচিত বন্ধুর মতো তাহাকে কোনো কথা বলিতে পারিল না। কোন্ দিকে চাহিবে, নিজের হাতখানা লইয়া কী করিবে, সে যেন একটা ভাবনার বিষয় হইয়া পড়িল। একবার উঠিয়া যাইবার চেষ্টা করিয়াছিল কিন্তু সুচরিতা কোনোমতেই তাহার কাপড় ছাড়িল না।
বিনয়ও যাহা-কিছু কথাবার্তা সমস্ত সুচরিতার সঙ্গেই চালাইল, ললিতার নিকট কোনো কথা ফাঁদা তাহার মতো বাক্পটু লোকের কাছেও আজ শক্ত হইয়া উঠিল। এইজন্যই সে যেন ডবল জোরে সুচরিতার সঙ্গে আলাপ করিতে লাগিল, কোথাও কোনো ফাঁক পড়িতে দিল না।