ললিতার প্রশ্নের উত্তরে পরেশবাবু কহিলেন, “বিনয়কে আমি তো খুব ভালো বলেই জানি। তাঁর বিদ্যাবুদ্ধিও যেমন চরিত্রও তেমনি।”
একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া ললিতা কহিল, “গৌরবাবুর মা এর মধ্যে দুদিন আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। সুচিদিদিকে নিয়ে তাঁর ওখানে আজ একবার যাব?”
পরেশবাবু ক্ষণকালের জন্য উত্তর দিতে পারিলেন না। তিনি নিশ্চয় জানিতেন বর্তমান আলোচনার সময় এইরূপ যাতায়াতে তাঁহাদের নিন্দা আরো প্রশ্রয় পাইবে। কিন্তু তাঁহার মন বলিয়া উঠিল, ‘যতক্ষণ ইহা অন্যায় নহে ততক্ষণ আমি নিষেধ করিতে পারিব না।’ কহিলেন, “আচ্ছা, যাও। আমার কাজ আছে, নইলে আমিও তোমাদের সঙ্গে যেতুম।”
বিনয় যেখানে এই কয়দিন অতিথিরূপে ও বন্ধুরূপে এমন নিশ্চিতভাবে পদার্পণ করিয়াছিল তাহার তলদেশে সামাজিক আগ্নেয়গিরি এমন সচেষ্টভাবে উত্তপ্ত হইয়া আছে তাহা সে স্বপ্নেও জানিত না। প্রথম যখন সে পরেশবাবুর পরিবারের সঙ্গে মিশিতেছিল তখন তাহার মনে যথেষ্ট সংকোচ ছিল; কোথায় কতদূর পর্যন্ত তাহার অধিকারের সীমা তাহা সে নিশ্চিত জানিত না বলিয়া সর্বদা ভয়ে ভয়ে চলিত। ক্রমে যখন তাহার ভয় ভাঙিয়া গেল তখন কোথাও যে কিছুমাত্র বিপদের শঙ্কা আছে তাহা তাহার মনেও হয় নাই। আজ হঠাৎ যখন শুনিল তাহার ব্যবহারে সমাজের লোকের নিকট ললিতাকে নিন্দিত হইতে হইতেছে তখন তাহার মাথায় বজ্র পড়িল। বিশেষত সকলের চেয়ে তাহার ক্ষোভের কারণ হইল এইজন্য যে, ললিতার সম্বন্ধে তাহার হৃদয়ের উত্তাপমাত্র সাধারণ বন্ধুত্বের রেখা ছাড়াইয়া অনেক ঊর্ধ্বে উঠিয়াছিল তাহা সে নিজে জানিত এবং বর্তমান ক্ষেত্রে যেখানে পরস্পরের সমাজ এমন বিভিন্ন সেখানে এরূপ তাপাধিক্যকে সে মনে মনে অপরাধ বলিয়াই গণ্য করিত। সে অনেক বার মনে করিয়াছে এই পরিবারের বিশ্বস্ত অতিথিরূপে আসিয়া সে নিজের ঠিক স্থানটি রাখিতে পারে নাই— এক জায়গায় সে কপটতা করিতেছে; তাহার মনের ভাবটি এই পরিবারের লোকের কাছে ঠিকমত প্রকাশ পাইলে তাহার পক্ষে লজ্জার কারণ হইবে।
এমন সময় যখন একদিন মধ্যাহ্নে বরদাসুন্দরী পত্র লিখিয়া বিনয়কে বিশেষ করিয়া ডাকিয়া আনিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘বিনয়বাবু, আপনি তো হিন্দু?’ এবং বিনয় তাহা স্বীকার করিলে পুনরায় প্রশ্ন করিলেন—‘হিন্দুসমাজ আপনি তো ত্যাগ করিতে পারিবেন না?’ এবং বিনয় তাহা তাহার পক্ষে অসম্ভব জানাইলে বরদাসুন্দরী যখন বলিয়া উঠিলেন ‘তবে কেন আপনি’— তখন সেই ‘তবে কেন’র কোনো উত্তর বিনয়ের মুখে জোগাইল না। সে একেবারে মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার মনে হইল সে যেন ধরা পড়িয়াছে; তাহার এমন একটা জিনিস এখানে সকলের কাছে প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে যাহা সে চন্দ্রসূর্যবায়ুর কাছেও গোপন করিতে চাহিয়াছিল। তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল— পরেশবাবু কী মনে করিতেছেন, ললিতা কী মনে করিতেছে, সুচরিতাই বা তাহাকে কী ভাবিতেছে! দেবদূতের কোন্ ভ্রমক্রমে এই-যে স্বর্গলোকে কিছুদিনের মতো তাহার স্থান হইয়াছিল— অনধিকার-প্রবেশের সমস্ত লজ্জা মাথায় করিয়া লইয়া এখান হইতে আজ তাহাকে একেবারে নির্বাসিত হইতে হইবে।