সত্যপ্রিয় পরেশবাবু অসংকোচে কহিলেন, “তুমি যা ভয় করছ তার কোনো হেতু নেই। আমি সুচরিতার কাছ থেকে শুনেছি ললিতার মন তোমার প্রতি বিমুখ নয়।”
বিনয়ের মনের মধ্যে একটা আনন্দের বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। ললিতার মনের একটি গূঢ় কথা সুচরিতার কাছে ব্যক্ত হইয়াছে। কবে ব্যক্ত হইল, কেমন করিয়া ব্যক্ত হইল? দুই সখীর কাছে এই-যে আভাসে অনুমানে একটা জানাজানি হইয়াছে ইহার সুতীব্র রহস্যময় সুখ বিনয়কে যেন বিদ্ধ করিতে লাগিল।
বিনয় বলিয়া উঠিল, “আমাকে যদি আপনারা যোগ্য মনে করেন তবে তার চেয়ে আনন্দের কথা আমার পক্ষে আর-কিছুই হতে পারে না।”
পরেশবাবু কহিলেন, “তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমি একবার উপর থেকে আসি।”
তিনি বরদাসুন্দরীর মত লইতে গেলেন। বরদাসুন্দরী কহিলেন, “বিনয়কে তো দীক্ষা নিতে হবে।”
পরেশবাবু কহিলেন, “তা নিতে হবে বৈকি।”
বরদাসুন্দরী কহিলেন, “সেটা আগে ঠিক করো। বিনয়কে এইখানেই ডাকাও-না।”
বিনয় উপরে আসিলে বরদাসুন্দরী কহিলেন, “তা হলে দীক্ষার দিন তো একটা ঠিক করতে হয়।”
বিনয় কহিল, “দীক্ষার কি দরকার আছে?”
বরদাসুন্দরী কহিলেন, “দরকার নেই! বল কী! নইলে ব্রাহ্ম সমাজে তোমার বিবাহ হবে কী করে?”
বিনয় চুপ করিয়া মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল। বিনয় তাঁহার ঘরে বিবাহ করিতে সম্মত হইয়াছে শুনিয়াই পরেশবাবু ধরিয়া লইয়াছিলেন যে, সে দীক্ষা গ্রহণ করিয়া ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করিবে।
বিনয় কহিল, “ব্রাহ্মসমাজের ধর্মমতের প্রতি আমার তো শ্রদ্ধা আছে এবং এপর্যন্ত আমার ব্যবহারেও তার অন্যথাচরণ হয় নি। তবে কি বিশেষভাবে দীক্ষা নেওয়ার দরকার আছে?
বরদাসুন্দরী কহিলেন, “যদি মতেই মিল থাকে তবে দীক্ষা নিতেই বা ক্ষতি কী?”
বিনয় কহিল, “আমি যে হিন্দুসমাজের কেউ নই এ কথা বলা আমার পক্ষে অসম্ভব।”
বরদাসুন্দরী কহিলেন, “তা হলে এ কথা নিয়ে আলোচনা করাই আপনার অন্যায় হয়েছে। আপনি কি আমাদের উপকার করবার জন্যে দয়া করে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন?”
বিনয় অত্যন্ত আঘাত পাইল; দেখিল তাহার প্রস্তাবটা ইঁহাদের পক্ষে সত্যই অপমানজনক হইয়া উঠিয়াছে।
কিছুকাল হইল সিভিল বিবাহের আইন পাস হইয়া গেছে। সে সময়ে গোরা ও বিনয় কাগজে ঐ আইনের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে আলোচনা করিয়াছে। আজ সেই সিভিল বিবাহ স্বীকার করিয়া বিনয় নিজেকে ‘হিন্দু নয়’ বলিয়া ঘোষণা করিবে এও তো বড়ো শক্ত কথা।
বিনয় হিন্দুসমাজে থাকিয়া ললিতাকে বিবাহ করিবে এ প্রস্তাব পরেশ মনের মধ্যে গ্রহণ করিতে পারিলেন না। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বিনয় উঠিয়া দাঁড়াইল এবং উভয়কে নমস্কার করিয়া কহিল, “আমাকে মাপ করবেন, আমি আর অপরাধ বাড়াব না।”
বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। সিঁড়ির কাছে আসিয়া দেখিল সম্মুখের বারান্দায় এক কোণে একটি ছোটো ডেস্ক্ লইয়া ললিতা একলা বসিয়া চিঠি লিখিতেছে। পায়ের শব্দে চোখ তুলিয়া ললিতা বিনয়ের মুখের দিকে চাহিল। সেই তাহার ক্ষণকালের দৃষ্টিটুকু বিনয়ের সমস্ত চিত্তকে এক মুহূর্তে মথিত করিয়া তুলিল। বিনয়ের সঙ্গে তো ললিতার নূতন পরিচয় নয়— কতবার সে