মহিম চলিয়া গেলেন, বিনয় তখনো কোনো কথা কহিল না। গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “কী বিনয়, ব্যাপারটা কী?”
বিনয় কহিল, “শুধু কেবল গোটাকতক খবর দিয়ে অবস্থাটা ঠিক বোঝানো ভারি শক্ত, তাই মনে করেছিলুম আস্তে আস্তে তোমাকে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব— কিন্তু পৃথিবীতে আমাদের সুবিধামত ধীরে-সুস্থে কিছুই ঘটতে চায় না— ঘটনাগুলোও শিকারি বাঘের মতো প্রথমটা গুঁড়ি মেরে মেরে নিঃশব্দে চলে, তার পরে হঠাৎ এক সময় ঘাড়ের উপরে লাফ দিয়ে এসে পড়ে। আবার তার সংবাদও আগুনের মতো প্রথমটা চাপা থাকে, তার পরে হঠাৎ দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, তখন তাকে আর সামলানো যায় না। সেইজন্যেই এক এক সময় মনে হয়, কর্মমাত্রই ত্যাগ করে একেবারে স্থাণু হয়ে বসে থাকাই মানুষের পক্ষে মুক্তি।”
গোরা হাসিয়া কহিল, “তুমি একলা স্থাণু হয়ে বসে থাকলেই বা মুক্তি কোথায়? সেইসঙ্গে জগৎ-সুদ্ধ যদি স্থাণু হয়ে না ওঠে তা হলে তোমাকে স্থির থাকতে দেবে কেন? সে আরো উলটো বিপদ হবে। জগৎ যখন কাজ করছে তখন তুমিও যদি কাজ না কর তা হলে যে কেবলই ঠকবে। সেইজন্যে এইটে দেখতে হবে ঘটনা যেন তোমার সতর্কতাকে ডিঙিয়ে না যায়— এটা না হয় যে, আর-সমস্তই চলছে, কেবল তুমিই প্রস্তুত নেই।”
বিনয় কহিল, “ঐ কথাটাই ঠিক। আমিই প্রস্তুত থাকি নে। এবারেও আমি প্রস্তুত ছিলুম না। কোন্ দিক দিয়ে কী ঘটছে তা বুঝতেই পারি নি। কিন্তু যখন ঘটে উঠল তখন তার দায়িত্ব তো গ্রহণ করতেই হবে। যেটা গোড়াতে না ঘটলেই ভালো ছিল সেটাকে আজ অপ্রিয় হলেও তো অস্বীকার করা যায় না।”
গোরা কহিল, “ঘটনাটা কী, না জেনে সেটার সম্বন্ধে তত্ত্বালোচনায় যোগ দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন।”
বিনয় খাড়া হইয়া বসিয়া বলিয়া ফেলিল, “অনিবার্য ঘটনাক্রমে ললিতার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, তাকে যদি আমি বিবাহ না করি তবে চিরজীবন সমাজে তাকে অন্যায় এবং অমূলক অপমান সহ্য করতে হবে।”
গোরা কহিল, “কী রকমটা দাঁড়িয়েছে শুনি।”
বিনয় কহিল, “সে অনেক কথা। সে ক্রমে তোমাকে বলব, কিন্তু ওটুকু তুমি মেনেই নাও।”
গোরা কহিল, “আচ্ছা, মেনেই নিচ্ছি। ও সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, ঘটনা যদি অনিবার্য হয় তার দুঃখও অনিবার্য। সমাজে যদি ললিতাকে অপমান ভোগ করতেই হয় তো তার উপায় নেই।”
বিনয় কহিল, “কিন্তু সেটা নিবারণ করা তো আমার হাতে আছে।”
গোরা কহিল, “যদি থাকে তো ভালোই। কিন্তু গায়ের জোরে সে কথা বললে তো হবে না। অভাবে পড়লে চুরি করা, খুন করাও তো মানুষের হাতে আছে, কিন্তু সেটা কি সত্যি আছে? ললিতাকে বিবাহ করে তুমি ললিতার প্রতি কর্তব্য করতে চাও, কিন্তু সেইটেই কি তোমার চরম কর্তব্য? সমাজের প্রতি কর্তব্য নেই?”
সমাজের প্রতি কর্তব্য স্মরণ করিয়াই বিনয় ব্রাহ্মবিবাহে সম্মত হয় নাই সে কথা সে বলিল না, তাহার তর্ক চড়িয়া উঠিল। সে কহিল, “ঐ জায়গায় তোমার সঙ্গে বোধ হয় আমার মিল হবে না। আমি তো ব্যক্তির দিকে টেনে সমাজের বিরুদ্ধে কথা বলছি নে। আমি বলছি, ব্যক্তি এবং সমাজ দুইয়ের উপরেই একটি ধর্ম আছে— সেইটের উপরে দৃষ্টি রেখে চলতে হবে। যেমন ব্যক্তিকে বাঁচানোই আমার চরম কর্তব্য নয় তেমনি সমাজকে বাঁচানোও আমার চরম কর্তব্য নয়, একমাত্র ধর্মকে বাঁচানোই আমার চরম শ্রেয়।”
গোরা কহিল, “ব্যক্তিও নেই সমাজও নেই, অথচ ধর্ম আছে, এমন ধর্মকে আমি মানি নে।”
বিনয়ের রোখ চড়িয়া উঠিল। সে কহিল, “আমি মানি। ব্যক্তি ও সমাজের ভিত্তির উপরে ধর্ম নয়, ধর্মের ভিত্তির উপরেই ব্যক্তি