আদিত্য। খুব ঠিক। সেই কাটা চুল দেখে আমি কেবল কাঁদতে বাকি রেখেছিলুম। তার পরদিন তোমাকে মুখ দেখাতে পারি নি লজ্জায়। পড়বার ঘরে চুপ করে ছিলেম বসে। তুমি ঘরে ঢুকেই হাত ধরে আমাকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে গেলে বাগানের কাজে, যেন কিছুই হয় নি। আর-একদিনের কথা মনে পড়ে, সেই যেদিন ফাল্গুন মাসে অকালে ঝড় উঠে আমার বিছন লাগাবার ঘরের চাল-উড়িয়ে নিয়েছিল তখন তুমি এসে—
সরলা। থাক্ আর বলতে হবে না। (দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে) সে-সব দিন আর আসবে না।
ব্যাকুলভাবে সরলার হাত চেপে ধরে
আদিত্য। না, যেয়ো না, এখনি যেয়ো না। কখন এক-সময়ে যাবার দিন আসবে তখন— (বলতে বলতে উত্তেজিতভাবে) কোনোদিন কেন যেতে হবে? কী অপরাধ ঘটেছে? ঈর্ষা? আজ দশ বৎসর সংসার-যাত্রায় আমার পরীক্ষা হল তারি এই পরিণাম! কী নিয়ে ঈর্ষা? তা হলে তো তেইশ বছরের ইতিহাস মুছে ফেলতে হয়, যখন থেকে তোমার সঙ্গে আমার দেখা।
সরলা। তেইশ বছরের কথা বলতে পারি নে ভাই, কিন্তু তেইশ বছরের এই শেষ বেলাতে ঈর্ষার কি কোনো কারণ ঘটে নি? সত্যি কথা তো বলতে হবে। নিজেকে ভুলিয়ে লাভ কী? তোমার আমার মধ্যে কোনো কথা যেন অস্পষ্ট না থাকে।
আদিত্য। অস্পষ্ট আর রইল না। অন্তরে অন্তরে বুঝেছি, তুমি নইলে আমার জগৎ হবে ব্যর্থ। যাঁর কাছ থেকে পেয়েছি তোমাকে জীবনের প্রথম বেলায়, তিনি ছাড়া আর কেউ তোমাকে কেড়ে নিতে পারবে না।
সরলা। কথা বোলো না আদিৎদা, দুঃখ আর বাড়িয়ো না। একটু স্থির হয়ে দাও ভাবতে।
আদিত্য। ভাবনা নিয়ে তো পিছনের দিকে যাওয়া যায় না। দুজনে যখন জীবন আরম্ভ করেছিলেম মেসোমশায়ের কোলের কাছে, সে তো না ভেবে চিন্তে। আজ কোনো রকমের নিড়ুনি দিয়ে কি উপড়ে ফেলতে পারবে সেই আমাদের দিনগুলিকে? তোমার কথা বলতে পারি নে সরি, আমার তো সাধ্য নেই।
সরলা। পায়ে পড়ি, দুর্বল কোরো না আমাকে। দুর্গম কোরো না উদ্ধারের পথ।
আদিত্য। (সরলার দুই হাত চেপে ধরে) উদ্ধারের পথ নেই, সে পথ আমি রাখব না। ভালোবাসি তোমাকে, এ কথা আজ এত সহজ করে সত্য করে বলতে পারছি, এতে আমার বুক ভরে উঠেছে। তেইশ বছর যা ছিল কুঁড়িতে, আজ দৈবের কৃপায় তা ফুটে উঠেছে। আমি বলছি, তাকে চাপা দিতে গেলে সে হবে ভীরুতা, সে হবে অধর্ম।
সরলা। চুপ, চুপ, আর বোলো না। আজকের রাত্তিরের মতো মাপ করো, মাপ করো আমাকে।
আদিত্য। সরি, আমিই কৃপাপাত্র, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। আমিই তোমার ক্ষমার যোগ্য। কেন আমি ছিলুম অন্ধ? কেন আমি তোমাকে চিনলুম না, কেন বিয়ে করতে গেলুম ভুল করে? তুমি তো কর নি, কত পাত্র এসেছিল তোমাকে কামনা করে সে তো আমি জানি।
সরলা। জ্যাঠামশায় যে আমাকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন তাঁর বাগানের কাজে, নইলে হয়তো—
আদিত্য। না না— তোমার মনের গভীরে ছিল তোমার সত্য উজ্জ্বল। না জেনেও তার কাছে তুমি বাঁধা রেখেছিলে নিজেকে।