এই শেষ কথাটা সুচরিতা হারানবাবুকে বিশেষ করিয়া আঘাত করিবার জন্যই বলিল। সে আজ অনেক সহিয়াছে, কিছু ফিরাইয়া না দিয়া থাকিতে পারিল না।
গোরা উঠিল। অপরাজিত হারানবাবু কহিলেন, “আমি তবে অপেক্ষা করি।”
সুচরিতা কহিল, “কেন মিথ্যা অপেক্ষা করবেন, আজ আর সময় হয়ে উঠবে না।”
কিন্তু হারানবাবু উঠিলেন না। সুচরিতা ও গোরা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
গোরাকে এ বাড়িতে দেখিয়া ও তাহার প্রতি সুচরিতার ব্যবহার লক্ষ করিয়া হারানবাবুর মন সশস্ত্র জাগিয়া উঠিল। ব্রাহ্মসমাজ হইতে সুচরিতা কি এমন করিয়া স্খলিত হইয়া যাইবে? তাহাকে রক্ষা করিবার কেহই নাই? যেমন করিয়া হোক ইহার প্রতিরোধ করিতেই হইবে।
হারানবাবু একখানা কাগজ টানিয়া লইয়া সুচরিতাকে পত্র লিখিতে বসিলেন। হারানবাবুর কতকগুলি বাঁধা বিশ্বাস ছিল। তাহার মধ্যে এও একটি যে, সত্যের দোহাই দিয়া যখন তিনি ভর্ৎসনা প্রয়োগ করেন তখন তাঁহার তেজস্বী বাক্য নিষ্ফল হইতে পারে না। শুধু বাক্যই একমাত্র জিনিস নহে, মানুষের মন বলিয়া একটা পদার্থ আছে সে কথা তিনি চিন্তাই করেন না।
আহারান্তে হরিমোহিনীর সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপ করিয়া গোরা তাহার লাঠি লইবার জন্য যখন সুচরিতার ঘরে আসিল তখন সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে। সুচরিতার ডেস্কের উপরে বাতি জ্বলিতেছে। হারানবাবু চলিয়া গেছেন। সুচরিতার-নাম-লেখা একখানি চিঠি টেবিলের উপর শয়ান রহিয়াছে, সেখানি ঘরে প্রবেশ করিলেই চোখে পড়ে।
সেই চিঠি দেখিয়াই গোরার বুকের ভিতরটা অত্যন্ত শক্ত হইয়া উঠিল। চিঠি যে হারানবাবুর লেখা তাহাতে সন্দেহ ছিল না। সুচরিতার প্রতি হারানবাবুর যে একটা বিশেষ অধিকার আছে তাহা গোরা জানিত, সেই অধিকারের যে কোনো ব্যত্যয় ঘটিয়াছে তাহা সে জানিত না। আজ যখন সতীশ সুচরিতার কানে কানে হারানবাবুর আগমনবার্তা জ্ঞাপন করিল এবং সুচরিতা সচকিত হইয়া দ্রুতপদে নীচে চলিয়া গেল ও অল্পকাল পরেই নিজে তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া উপরে লইয়া আসিল তখন গোরা মনে খুব একটা বেসুর বাজিয়াছিল। তাহার পরে হারানবাবুকে যখন ঘরে একলা ফেলিয়া সুচরিতা গোরাকে খাইতে লইয়া গেল তখন সে ব্যবহারটা কড়া ঠেকিয়াছিল বটে, কিন্তু ঘনিষ্ঠতার স্থলে এরূপ রূঢ় ব্যবহার চলিতে পারে মনে করিয়া গোরা সেটাকে আত্মীয়তার লক্ষণ বলিয়াই স্থির করিয়াছিল। তাহার পরে টেবিলের উপর এই চিঠিখানা দেখিয়া গোরা খুব একটা ধাক্কা পাইল। চিঠি বড়ো একটা রহস্যময় পদার্থ। বাহিরে কেবল নামটুকু দেখাইয়া সব কথাই সে ভিতরে রাখিয়া দেয় বলিয়া সে মানুষকে নিতান্ত অকারণে নাকাল করিতে পারে।
গোরা সুচরিতার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “আমি কাল আসব।”
সুচরিতা আনতনেত্রে কহিল, “আচ্ছা।”
গোরা বিদায় লইতে উন্মুখ হইয়া হঠাৎ থামিয়া দাঁড়াইয়া বলিয়া উঠিল, “ভারতবর্ষের সৌরমণ্ডলের মধ্যেই তোমার স্থান— তুমি আমার আপন দেশের— কোনো ধূমকেতু এসে তোমাকে যে তার পুচ্ছ দিয়ে ঝেঁটিয়ে নিয়ে শূন্যের মধ্যে চলে যাবে সে কোনোমতেই হতে পারবে না। যেখানে তোমার প্রতিষ্ঠা সেইখানেই তোমাকে দৃঢ় করে প্রতিষ্ঠিত করব তবে আমি ছাড়ব। সে জায়গায় তোমার সত্য, তোমার ধর্ম, তোমাকে পরিত্যাগ করবে এই কথা এরা তোমাকে বুঝিয়েছে— আমি তোমাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেব তোমার সত্য— তোমার ধর্ম— কেবল তোমার কিংবা আর দু-চার জনের মত বা বাক্য নয়; সে চারি দিকের সঙ্গে অসংখ্য প্রাণের সূত্রে জড়িত— তাকে ইচ্ছা করলেই বন থেকে উপড়ে নিয়ে টবের মধ্যে পোঁতা যায় না— যদি তাকে উজ্জ্বল করে সজীব করে রাখতে চাও, যদি তাকে সর্বাঙ্গীণরূপে সার্থক করে তুলতে চাও, তবে তোমার জন্মের বহু পূর্বে যে লোকসমাজের হৃদয়ের মধ্যে তোমার স্থান নির্দিষ্ট হয়ে গেছে সেইখানে তোমাকে আসন নিতেই হবে— কোনোমতেই বলতে পারবে না, আমি ওর পর, ও