আনন্দময়ী কহিলেন, “কপটতা না করে থাকবার সাহস নেই? সমাজের লোকে কষ্ট দেবে— তা, কষ্ট সহ্য করে থাকতে পারবি নে?”
বিনয় কহিল, “মা, আমি যদি হিন্দুসমাজের মতে না চলি তা হলে— ”
আনন্দময়ী কহিলেন, “হিন্দুসমাজে যদি তিন শো তেত্রিশ কোটি মত চলতে পারে তবে তোমার মতই বা চলবে না কেন?”
বিনয় কহিল, “কিন্তু, মা, আমাদের সমাজের লোক যদি বলে তুমি হিন্দু নও তা হলে আমি কি জোর করে বললেই হল আমি হিন্দু?”
আনন্দয়মী কহিলেন, “আমাকে তো আমাদের সমাজের লোকে বলে খৃস্টান— আমি তো কাজে-কর্মে তাদের সঙ্গে একত্রে বসে খাই নে। তবুও তারা আমাকে খৃস্টান বললেই সে কথা আমাকে মেনে নিতে হবে এমন তো আমি বুঝি নে। যেটাকে উচিত বলে জানি সেটার জন্যে কোথাও পালিয়ে বসে থাকা আমি অন্যায় মনে করি।”
বিনয় ইহার উত্তর দিতে যাইতেছিল। আনন্দময়ী তাহাকে কিছু বলিতে না দিয়াই কহিলেন, “বিনয়, তোকে আমি তর্ক করতে দেব না, এ তর্কের কথা নয়। তুই আমার কাছে কি কিছু ঢাকতে পারিস? আমি যে দেখতে পাচ্ছি তুই আমার সঙ্গে তর্ক করবার ছুতো ধরে জোর করে আপনাকে ভোলাবার চেষ্টা করছিস। কিন্তু এতবড়ো গুরুতর ব্যাপারে ওরকম ফাঁকি চালাবার মতলব করিস নে।”
বিনয় মাথা নিচু করিয়া কহিল, “কিন্তু, মা, আমি তো চিঠি লিখে কথা দিয়ে এসেছি কাল আমি দীক্ষা নেব।”
আনন্দময়ী কহিলেন, “সে হতে পারবে না। পরেশবাবুকে যদি বুঝিয়ে বলিস তিনি কখনোই পীড়াপীড়ি করবেন না।”
বিনয় কহিল, “পরেশবাবুর এ দীক্ষায় কোনো উৎসাহ নেই— তিনি এ অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন না।”
আনন্দময়ী কহিলেন, “তবে তোকে কিছু ভাবতে হবে না।”
বিনয় কহিল, “না মা, কথা ঠিক হয়ে গেছে, এখন আর ফেরানো যাবে না। কোনোমতেই না।”
আনন্দময়ী কহিলেন, “গোরাকে বলেছিস?”
বিনয় কহিল, “গোরার সঙ্গে আমার দেখা হয় নি।”
আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন, গোরা এখন বাড়িতে নেই?”
বিনয় কহিল, “না, খবর পেলুম সে সুচরিতার বাড়িতে গেছে।’
আনন্দময়ী বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “সেখানে তো সে কাল গিয়েছিল।”
বিনয় কহিল, “আজও গেছে।”
এমন সময় প্রাঙ্গণে পালকির বেহারার আওয়াজ পাওয়া গেল। আনন্দময়ীর কোনো কুটুম্ব স্ত্রীলোকের আগমন কল্পনা করিয়া বিনয় বাহিরে চলিয়া গেল।
ললিতা আসিয়া আনন্দময়ীকে প্রণাম করিল। আজ আনন্দময়ী কোনোমতেই ললিতার আগমন প্রত্যাশা করেন নাই। তিনি বিস্মিত হইয়া ললিতার মুখের দিকে চাহিতেই বুঝিলেন, বিনয়ের দীক্ষা প্রভৃতি ব্যাপার লইয়া ললিতার একটা কোথাও সংকট উপস্থিত হইয়াছে, তাই সে তাঁহার কাছে আসিয়াছে।
তিনি কথা পাড়িবার সুবিধা করিয়া দিবার জন্য কহিলেন, “মা, তুমি এসেছ বড়ো খুশি হলুম। এইমাত্র বিনয় এখানে ছিলেন— কাল তিনি তোমাদের সমাজে দীক্ষা নেবেন আমার সঙ্গে সেই কথাই হচ্ছিল।”
ললিতা কহিল, “কেন তিনি দীক্ষা নিতে যাচ্ছেন? তার কি কোনো প্রয়োজন আছে?”