Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://xn--u5bxfcqewdax4kraj7ob.xn--45brj9c)


গোরা-৬১,২৪৫
গোরা
কোনোমতেই বলতে পারব না এখানে প্রকৃতির নিয়মই কাজ করতে থাক্‌। আমাদের কূলকে আমরা পাথর দিয়েই বাঁধিয়ে রাখব, তাতে আমাদের নিন্দাই কর আর যাই কর। এ আমাদের পবিত্র প্রাচীন পুরী— এর উপরে বৎসরে বৎসরে নূতন মাটির পলি পড়বে আর চাষার দলে লাঙল নিয়ে এর জমি চষবে, এটা আমাদের অভিপ্রেত নয়, তাতে আমাদের যা লোকসান হয় হোক। এ আমাদের বাস করবার, এ চাষ করবার নয়। অতএব তোমাদের কৃষিবিভাগ থেকে আমাদের এই পাথরগুলোকে যখন কঠিন বলে নিন্দা কর তখন তাতে আমরা মর্মান্তিক লজ্জা বোধ করি নে।”

বিনয় কহিল, “অর্থাৎ, সংক্ষেপে, তুমি আমাদের এই বিবাহকে স্বীকার করবে না।”

গোরা কহিল, “নিশ্চয় করব না।”

বিনয় কহিল, “এবং— ”

গোরা কহিল, “এবং তোমাদের ত্যাগ করব।”

বিনয় কহিল, “আমি যদি তোমার মুসলমান বন্ধু হতুম?”

গোরা কহিল, “তা হলে অন্য কথা হত। গাছের আপন ডাল ভেঙে প’ড়ে যদি পর হয়ে যায় তবে গাছ তাকে কোনোমতেই পূর্বের মতো আপন করে ফিরে নিতে পারে না, কিন্তু বাইরে থেকে যে লতা এগিয়ে আসে তাকে সে আশ্রয় দিতে পারে, এমন-কি, ঝড়ে ভেঙে পড়লে আবার তাকে তুলে নিতে কোনো বাধা থাকে না। আপন যখন পর হয় তখন তাঁকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করা ছাড়া অন্য কোনো গতি নেই। সেইজন্যেই তো এত বিধিনিষেধ, এত প্রাণপণ টানাটানি।”

বিনয় কহিল, “সেইজন্যেই তো ত্যাগের কারণ অত হালকা এবং ত্যাগের বিধান অত সুলভ হওয়া উচিত ছিল না। হাত ভাঙলে আর জোড়া লাগে না বটে, সেইজন্যেই কথায় কথায় হাত ভাঙেও না। তার হাড় খুব মজবুত। যে সমাজে অতি সামান্য ঘা লাগলেই বিচ্ছেদ ঘটে এবং সে বিচ্ছেদ চিরবিচ্ছেদ হয়ে দাঁড়ায় সে সমাজে মানুষের পক্ষে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা— কাজকর্ম করার পক্ষে বাধা কত সে কথা কি চিন্তা করে দেখবে না?”

গোরা কহিল, “সে চিন্তার ভার আমার উপর নেই। সমাজ এমন সমগ্রভাবে এমন বড়োরকম করে চিন্তা করছে যে আমি টেরও পাচ্ছিনে সে ভাবছে। হাজার হাজার বৎসর ধরে সে ভেবেওছে এবং আপনাকে রক্ষাও করে এসেছে, এই আমার ভরসা। পৃথিবী সূর্যের চারি দিকে বেঁকে চলছে কি সোজা চলছে, ভুল করছে কি করছে না, সে যেমন আমি ভাবি নে এবং না ভেবে আজ পর্যন্ত আমি ঠকি নি— আমার সমাজ সম্বন্ধেও আমার সেই ভাব।”

বিনয় হাসিয়া কহিল, “ভাই গোরা, ঠিক এই-সব কথা আমিও এতদিন এমনি করেই বলে এসেছি, আজ আবার আমাকেও সে কথা শুনতে হবে তা কে জানত! কথা বানিয়ে বলবার শাস্তি আজ আমাকে ভোগ করতে হবে সে আমি বেশ বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তর্ক করে কোনো লাভ নেই। কেননা, একটা কথা আমি আজ খুব নিকটের থেকে দেখতে পেয়েছি, সেটি পূর্বে দেখি নি— আজ বুঝেছি মানুষের জীবনের গতি মহানদীর মতো, সে আপনার বেগে অভাবনীয় রূপে এমন নূতন নূতন দিকে পথ করে নেয় যে দিকে পূর্বে তার স্রোত ছিল না। এই তার গতির বৈচিত্র্য— তার অভাবনীয় পরিণতিই বিধাতার অভিপ্রায়; সে কাটা খাল নয়, তাকে বাঁধা পথে রাখা চলবে না। নিজের মধ্যেই যখন এ কথাটা একেবারে প্রত্যক্ষ হয়েছে তখন কোনো সাজানো কথায় আর আমাকে কোনোদিন ভোলাতে পারবে না।”

গোরা কহিল, “পতঙ্গ যখন বহ্নির মুখে পড়তে চলে সেও তখন তোমার মতো ঠিক ঐরকম তর্কই করে, অতএব তোমাকে আমিও আজ বোঝাবার কোনো বৃথা চেষ্টা করব না।”

বিনয় চৌকি হইতে উঠিয়া কহিল, “সেই ভালো, তবে চললুম, একবার মা’র সঙ্গে দেখা করে আসি।”