সুচরিতার বাড়িতে আজ গোরার যাইবার কোনো কথা ছিল না, কোনো কারণও ছিল না। কিন্তু গোরার স্বভাবে দ্বিধা জিনিসটা অত্যন্ত কম। সে যখন কিছুতে প্রবৃত্ত হয় তখন সে সম্বন্ধে সে চিন্তাই করে না। একেবারে তীরের মতো সোজা চলিয়া যায়।
আজ প্রাতঃকালে সুচরিতার ঘরে গিয়া গোরা যখন উঠিল তখন হরিমোহিনী পূজায় প্রবৃত্ত ছিলেন। সুচরিতা তাহার বসিবার ঘরে টেবিলের উপরকার বই খাতা কাগজ প্রভৃতি পরিপাটি করিয়া গুছাইয়া রাখিতেছিল, এমন সময় সতীশ আসিয়া যখন খবর দিল গৌরবাবু আসিয়াছেন তখন সুচরিতা বিশেষ বিস্ময় অনুভব করিল না। সে যেন মনে করিয়াছিল, আজ গোরা আসিবে।
গোরা চৌকিতে বসিয়া কহিল, “শেষকালে বিনয় আমাদের ত্যাগ করলে?”
সুচরিতা কহিল, “কেন, ত্যাগ করবেন কেন, তিনি তো ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন নি।”
গোরা কহিল, “ব্রাহ্মসমাজে বেরিয়ে গেলে তিনি এর চেয়ে আমাদের বেশি কাছে থাকতেন। তিনি হিন্দুসমাজকে আঁকড়ে ধরে আছেন বলেই একে সব চেয়ে বেশি পীড়ন করছেন। এর চেয়ে আমাদের সমাজকে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি দিলেই তিনি ভালো করতেন।”
সুচরিতা মনের মধ্যে একটা কঠিন বেদনা পাইয়া কহিল, “আপনি সমাজকে এমন অতিশয় একান্ত করে দেখেন কেন? সমাজের উপর আপনি যে এত বেশি বিশ্বাস স্থাপন করেছেন এ কি আপনার পক্ষে স্বাভাবিক? না, অনেকটা নিজের উপর জোর প্রয়োগ করেন?”
গোরা কহিল, “এখনকার অবস্থায় এই জোর প্রয়োগ করাটাই যে স্বাভাবিক। পায়ের নীচে যখন মাটি টলতে থাকে তখন প্রত্যেক পদেই পায়ের উপর বেশি করে জোর দিতে হয়। এখন যে চারি দিকেই বিরুদ্ধতা, সেইজন্য আমাদের বাক্যে এবং ব্যবহারে একটা বাড়াবাড়ি প্রকাশ পায়। সেটা অস্বাভাবিক নয়।”
সুচরিতা কহিল, “চারি দিকে যে বিরুদ্ধতা দেখছেন সেটাকে আপনি আগাগোড়া অন্যায় এবং অনাবশ্যক কেন মনে করছেন? সমাজ যদি কালের গতিকে বাধা দেয় তা হলে সমাজকে যে আঘাত পেতেই হবে।”
গোরা কহিল, “কালের গতি হচ্ছে জলের ঢেউয়ের মতো, তাতে ডাঙাকে ভাঙতে থাকে, কিন্তু সেই ভাঙনকে স্বীকার করে নেওয়াই যে ডাঙার কর্তব্য আমি তা মনে করি নে। তুমি মনে কোরো না সমাজের ভালোমন্দ আমি কিছুই বিচার করি নে। সেরকম বিচার করা এতই সহজ যে, এখনকার কালের ষোলো বছরের বালকও বিচারক হয়ে উঠেছে। কিন্তু শক্ত হচ্ছে সমগ্র জিনিসকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে সমগ্র ভাবে দেখতে পাওয়া।”
সুচরিতা কহিল, “শ্রদ্ধার দ্বারা আমরা কি কেবল সত্যকেই পাই? তাতে করে মিথ্যাকেও তো আমরা অবিচারে গ্রহণ করি? আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, আমরা কি পৌত্তলিকতাকেও শ্রদ্ধা করতে পারি? আপনি কি এ-সমস্ত সত্য বলেই বিশ্বাস করেন?”
গোরা একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “আমি তোমাকে ঠিক সত্য কথাটা বলবার চেষ্টা করব। আমি গোড়াতেই