গোরা যখন বাড়ি আসিয়া পৌঁছিল তখন দ্বারের সম্মুখে রাস্তার উপর বেঞ্চি পাতিয়া খোলা গায়ে মহিম তামাক খাইতেছিলেন। আজ তাঁহার আপিসের ছুটি। গোরাকে ভিতরে ঢুকিতে দেখিয়া তিনিও তাহার পশ্চাতে গিয়া তাহাকে ডাকিয়া কহিলেন, “গোরা, শুনে যাও, একটি কথা আছে।”
গোরাকে নিজের ঘরে লইয়া গিয়া মহিম কহিলেন, “রাগ কোরো না, ভাই, আগে জিজ্ঞাসা করছি, তোমাকেও বিনয়ের ছোঁয়াচ লেগেছে নাকি? ও অঞ্চলে যে বড়ো ঘন ঘন যাওয়া-আসা চলছে!”
গোরার মুখ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। সে কহিল, “ভয় নেই।”
মহিম কহিলেন, “যেরকম গতিক দেখছি কিছু তো বলা যায় না। তুমি ভাবছ ওটা একটা খাদ্যদ্রব্য, দিব্যি গিলে ফেলে তার পরে আবার ঘরে ফিরে আসবে। কিন্তু বঁড়শিটি ভিতরে আছে, সে তোমার বন্ধুর দশা দেখলেই বুঝতে পারবে। আরে, যাও কোথায়! আসল কথাটাই এখনো হয় নি। ও দিকে ব্রাহ্ম মেয়ের সঙ্গে বিনয়ের বিয়ে তো একেবারে পাকা হয়ে গেছে শুনতে পাচ্ছি। তার পর কিন্তু ওর সঙ্গে আমাদের কোনোরকম ব্যবহার চলবে না, সে আমি তোমাকে আগে থাকতেই বলে রাখছি।”
গোরা কহিল, “ সে তো চলবেই না।”
মহিম কহিলেন, “কিন্তু মা যদি গোলমাল করেন তা হলে সুবিধা হবে না। আমরা গৃহস্থ মানুষ, অমনিতেই মেয়েছেলের বিয়ে দিতে জিব বেরিয়ে পড়ে, তার পরে যদি ঘরের মধ্যে ব্রাহ্মসমাজ বসাও তা হলে আমাকে কিন্তু এখান থেকে বাস ওঠাতে হবে।”
গোরা কহিল, “না, সে কিছুতেই হবে না।”
মহিম কহিলেন, “শশীর বিবাহের প্রস্তাবটা ঘনিয়ে আসছে। আমাদের বেহাই যতটুকু পরিমাণ মেয়ে ঘরে নেবেন সোনা তার চেয়ে বেশি না নিয়ে ছাড়বেন না; কারণ, তিনি জানেন মানুষ নশ্বর পদার্থ, সোনা তার চেয়ে বেশি দিন টেঁকে। ওষুধের চেয়ে অনুপানটার দিকেই তাঁর ঝোঁক বেশি। বেহাই বললে তাঁকে খাটো করা হয়, একেবারে বেহায়া। কিছু খরচ হবে বটে, কিন্তু লোকটার কাছে আমার অনেক শিক্ষা হল, ছেলের বিয়ের সময় কাজে লাগবে। ভারি লোভ হচ্ছিল আর-এক বার এ কালে জন্মগ্রহণ করে বাবাকে মাঝখানে বসিয়ে রেখে নিজের বিয়েটা একবার বিধিমত পাকিয়ে তুলি— পুরুষজন্ম যে গ্রহণ করেছি সেটাকে একেবারে ষোলো-আনা সার্থক করে নিই। একেই তো বলে পৌরুষ। মেয়ের বাপকে একেবারে ধরাশায়ী করে দেওয়া। কম কথা! যাই বল, তোমার সঙ্গে যোগ দিয়ে যে নিশিদিন হিন্দুসমাজের জয়ধ্বনি করব কিছুতেই তাতে জোর পাচ্ছি নে ভাই, গলা উঠতে চায় না, একেবারে কাহিল করে ফেলেছে। আমার তিনকড়েটার বয়স এখন সবে চৌদ্দ মাস— গোড়ায় কন্যা জন্ম দিয়ে শেষে তার ভ্রম সংশোধন করতে সহধর্মিণী দীর্ঘকাল সময় নিয়েছেন। যা হোক, ওরই বিবাহের সময়টা পর্যন্ত, গোরা, তোমরা সকলে মিলে হিন্দুসমাজটাকে তাজা রেখো— তারপর দেশের লোক মুসলমান হোক, খৃস্টান হোক, আমি কোনো কথা কব না।”
গোরা উঠিয়া দাঁড়াতেই মহিম কহিলেন, “তাই আমি বলছিলুম, শশীর বিবাহের সভায় তোমাদের বিনয়কে নিমন্ত্রণ করা চলবে না। তখন যে এই কথা নিয়ে আবার একটা কাণ্ড বাধিয়ে তুলবে সে হবে না। মাকে তুমি এখন থেকে সাবধান করে রেখে দিয়ো।”
মাতার ঘরে আসিয়া গোরা দেখিল আনন্দময়ী মেজের উপর বসিয়া চশমা চোখে আঁটিয়া একটা খাতা লইয়া কিসের ফর্দ করিতেছেন। গোরাকে দেখিয়া তিনি চশমা খুলিয়া খাতা বন্ধ করিয়া কহিলেন, “বোস্।”
গোরা বসিলে আনন্দময়ী কহিলেন, “তোর সঙ্গে আমার একটা পরামর্শ আছে। বিনয়ের বিয়ের খবর তো পেয়েছিস?”
গোরা চুপ করিয়া রহিল। আনন্দময়ী কহিলেন, “বিনয়ের কাকা রাগ করেছেন, তাঁরা কেউ আসবেন না। আবার পরেশবাবুর