বিপ্রদাস। তুমি তো জান সুবোধ টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে।
দেওয়ানজি। তিনি তো ছেলেমানুষ নন, বুঝবেন না কি টাকা না থাকলে টাকা দেওয়া যায় না?
বিপ্রদাস। সুবোধ দূরে গিয়ে পড়েছে। দরদ দিয়ে বোঝবার এলেকা সে পেরিয়ে গেছে, বোঝাতে চেষ্টা করলে দ্বিগুণ অবুঝ হয়ে উঠবে— ভালো ফল হবে না।
দেওয়ানজি। বড়োবাবু, একটা কথা ভেবে দেখবার সময় হয়েছে। মধুসূদন ঘোষাল হঠাৎ গায়ে পড়ে আমাদের চাটুজ্জেগুষ্টির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এল, আমাদের সব দেনা এক ক’রে এগারো লাখ টাকা কম সুদে তোমাকে ধার দিলে, একদিন হঠাৎ তার অপঘাত এসে পড়বে আমাদের ঘাড়ের উপর, তার জন্যে তো সময় থাকতে প্রস্তুত হতে হবে।
বিপ্রদাস। অপঘাতের জন্যে দশ-বিশটা ডাণ্ডা ওঁচানো ছিল দশ-বিশ জন মহাজনের হাতে। তার জায়গায় একখানা মোটা ডাণ্ডা এসে ঠেকেছে কেবল ওই ঘোষালের হাতে। আগেকার চেয়ে এতে কি বেশি ভাবনার কারণ ঘটেছে?
দেওয়ানজি। তবে শোনো, সে তোমার জন্মের আগেকার কথা, স্বর্গীয় কর্তাবাবুর দপ্তরে তখন আমি মুনশিগিরিতে সবে ভর্তি হয়েছি। সেই সময়ে চাটুজ্জে আর ঘোষাল বংশে ভীষণ কাজিয়া বেধে গেল কার্তিক মাসে বিসর্জনের মিছিল নিয়ে। দু-পাঁচটা খুনোখুনি হয়ে গেল। তারই মকর্দমায় ঘোষালরা উচ্ছন্ন হয়ে বেরিয়ে পড়ল পথে। সেই বংশের ছেলে মধুসূদন একদিন রজবপুরে পাটের আড়তে আট টাকা মাইনের মুহুরিগিরিতে ঢুকে আজ ক্রোড়পতি হয়ে উঠেছে, সে হঠাৎ তোমার সঙ্গে আত্মীয়তা করতে আসে কেন?
বিপ্রদাস। সে তো বহু পুরোনো ইতিহাসের কথা।
দেওয়ানজি। বড়োবাবু, তোমার সরল মন, এই সহজ কথাটা বুঝতে পারছ না— তোমরা মেরেছিলে, ওরা মার খেয়েছিল। তোমাদের ইতিহাস ফিকে হয়ে এসেছে, কিন্তু ওদের ইতিহাস রক্তের অক্ষরে লেখা।
বিপ্রদাস। তা হতে পারে, কিন্তু কী পরামর্শ দাও শুনি।
দেওয়ানজি। তুমি যে ছোটোবাবুর খেয়ালে আজ তালুক বিকিয়ে দিতে বসেছ সেটা ভালো কথা নয়— সমস্তই হাতে রাখতে হবে শেষ মারটা ঠেকাবার জন্যে। চুপ করে রইলে যে। কথাটা মনে নিচ্ছে না! তোমরা হচ্ছ রাজার বংশের ছেলে, আমরা মন্ত্রীর বংশের। বরাবর দেখে আসছি— যে ডালে দাঁড়াও সেই ডালে তোমরা কোপ মার, আর আমরা তলায় দাঁড়িয়ে বৃথা দোহাই পাড়ি। তোমাদেরই সর্বনেশে জেদ বজায় থাকে। শেষকালে ধুপ করে ঘারে এসে পড়ে ওই হতভাগা মন্ত্রীর ছেলেরই।
বিপ্রদাস। সুবোধ যখন এমন কথা লিখতে পেরেছে যে সম্পত্তিতে তার অর্ধেক অংশ বেচে তাকে টাকা পাঠাতে হবে, তখন এর চেয়ে বড়ো আঘাতের কথা আমি ভাবতে পারি নে। আমার সম্পত্তি আর তার সম্পত্তিতে আজ তার ভেদবুদ্ধি ঘটল! এক দেহকে দু ভাগ করবার কথা আজ সে ভাবতে পারলে! এ নিয়ে আর কোনো কথা বলতে চাই নে— আমি চললুম। এখনো আমার সকালবেলার অনেক কাজ বাকি আছে।
[ প্রস্থান
কুমুদিনী। কাকাবাবু, ছোড়দাদা এমন চিঠি কী করে লিখতে পারলেন?
দেওয়ানজি। সে কথা ভেবে লাভ কী মা! দুঃখ যার সহ্য করবার মহত্ত্ব আছে, ভগবান তারই ধৈর্যের কঠিন পরীক্ষা করেন। তোমার দাদা দুঃখ পাবেন জানি, কিন্তু হারবেন না সেও জানি।
কুমুদিনী। কাকাবাবু, মায়ের দেওয়া আমার গয়না তোমারই তো জিম্মেয় আছে। সেইগুলো বেচে তুমি দাদাকে ভাবনা থেকে বাঁচাও-না।
দেওয়ানজি। সর্বনাশ! তাঁর মনকে ঠাণ্ডা করবার চেষ্টায় তাকে কি আরো আগুন করে তুলতে হবে? শান্তিরক্ষা করার সহজ