অখিল। খুড়ো, তুমি ভাবছ বড়োবাবুকে তুমি ঠেকাতে পেরেছ? তিনি রাত দশটার পরে ঘোড়ায় চড়ে সাত ক্রোশ পথ পেরিয়ে স্টেশনে গিয়ে হাজির। রাত্তির একটার পর গাড়ি এল, তার পরে ভাবী ভগ্নীপতির সঙ্গে তোমার দাদার যে সদালাপ হল সে স্টেশনমাস্টারের কাছেই শুনতে পাবে।
নবগোপাল। কী রকম শুনি!
অখিল। সেলুন থেকে রাজা নামলে বুক ফুলিয়ে দলবল সমেত। বড়োবাবুকে দেখে সংক্ষেপে একটা শুকনো নমস্কার করে বললে, ‘আপনার আসবার কী দরকার ছিল? আমি তো খবর দিই নি।’ বড়োবাবু বললেন, ‘আমার দেশে এই তোমার প্রথম আসা, অভ্যর্থনা করব না? ’ রাজা বলে উঠল, ‘ভুল করছেন, আপনার দেশে এখনো আসি নি। আসব বিয়ের দিনে।’ বড়োবাবু বুঝলেন সুবিধে নয়, বললেন, ‘খাওয়াদাওয়ার জিনিসপত্র তৈরি, বজরা আছে ঘাটে।’ লোকটা জবাব দিলে, ‘কিছু দরকার হবে না। আমার স্টীম লঞ্চ্ প্রস্তুত। একটা কথা মনে রাখবেন, এসেছি আমারই পূর্বপুরুষের জন্মভূমিতে, আপনার দেশে নয়। সাতাশে তারিখে সেখানে যাবার কথা।’ সেই রাত্রেই বড়োবাবু ফিরে এলেন— তার পর দিন থেকে জ্বর, গায়ে ব্যথা, একেবারে শয্যাগত।
নবগোপাল। কী আর বলব! সাত জন্মের পাপে কন্যাকর্তা হয়ে জন্মেছি, অযোগ্যের ল্যাজের ঝাপটা চুপ করেই সইতে হয়। তা হোক, তবু এখান থেকে যাবার আগেই ওঁর আড়তদারি দেমাকের বারো আনাই নিজের পেটে হজম করে ওঁকে ফিরতে হবে— সহজে ছাড়ব না। দেওয়ানজি আসছেন।
দেওয়ানজির প্রবেশ
নবগোপাল। দেওয়ানজি, ব্যাপারখানা দেখছেন তো।
দেওয়ানজি। দেখবার জন্যে চশমা লাগাবার দরকার হবে না, ব্যাপারটা প্রকাণ্ড বড়ো হয়ে উঠেছে।
নবগোপাল। আমরা ভাবছি আপনাদের জামাইয়ের পদগৌরবের উপযুক্ত নাগরা জুতো মিলবে কোন্ দোকানে।
দেওয়ানজি। জামাইবাবুর খুব বড়ো মাপের পা বটে, এরই মধ্যে আমাদের নুরনগরের সীমানা অনেকখানিই পদতলস্থ করেছেন। আজ চাটুজ্জেরাই হল অপদস্থ।
নবগোপাল। কী রকম?
দেওয়ানজি। ওদের পূর্বপুরুষের নামের দিঘি ঘোষালদিঘি, তার চার দিক ঘিরে তাঁবু গেড়ে বেড়া তুলে সেটাকে মধুপুরী নাম দিয়ে জেঁকে বসেছেন।
নবগোপাল। সে তো জানি। বেশ বোঝা গেছে বিয়ে করতে আসাটা উপলক্ষ, দেমাক করতে আসাই লক্ষ্য। আমাদের প্রজারা তো ক্ষেপে উঠেছে।
দেওয়ানজি। দাদাবাবু, তুমিই তো তাদের বেশি করে ক্ষেপিয়ে তুলেছ।
নবগোপাল। আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে উনি ধুম করে আইবুড়ো ভাতের নেমন্তন্ন জারি করলেন বিশ গাঁয়ে। গাছতলায় গর্ত করে বড়ো বড়ো উনুন পাতা হল, তার চার দিকে নানা বহরের হাঁড়ি হাড়া মালসা কলসি জালা— সারি সারি গোরুর গাড়িতে করে দুদিন ধরে আসতেই লেগেছে আলু বেগুন কাঁচকলা, ঘি ময়দা ক্ষীর সন্দেশ। আমি ঘরে ঘরে জানিয়ে দিয়েছি, খবরদার কেউ যেন ওর পাত চাটতে না আসে।