দেওয়ানজি। তা, দু-চার জন ভিখিরি আর ভিন্ গাঁয়ের লোক ছাড়া আর কেউ আসে নি খেতে। রোশনাই জ্বলল, রসুনচৌকি বাজল, শীতের রাত, আটটা নটা দশটা বাজল, গোবর দিয়ে নিকোনো পাতা-পাড়া প্রকাণ্ড আঙিনা শূন্য ধূ ধূ করতে থাকল, জনপ্রাণী আসে না।
নবগোপাল। সেই সময়টাতে আমাদের দুই বাড়ির চারটে হাতিকে গলার ঘন্টা ঢংঢঙিয়ে রাস্তার সামনে দিয়ে টহল করানো হয়েছিল তো?
দেওয়ানজি। হয়েছিল। দাদাবাবু, তোমার কথা শুনে এই কাজটি হয়েছে— কিন্তু আমার মন ভালো নেই। শুনেছি ওদের পরামর্শ হয়েছে বিয়ের দিনে বরযাত্ররা আলো নিবিয়ে বাজনা থামিয়ে চুপচাপ আসবে, কেউ আমাদের ওখানে জলস্পর্শ করবে না।
নবগোপাল। অনেক পরিশ্রম বেঁচে যাবে। খেল কী না খেল লক্ষ্যই কোরো না, আর যাই কর সাধতে যেয়ো না।
দেওয়ানজি। আমাদের তো একদিনের হারজিতের সম্বন্ধ নয় দাদাবাবু। মেয়ে যে দেওয়া হচ্ছে ওদের ঘরে, চিরদিনের জন্যেই যে হার মেনে থাকতে হবে।
নবগোপাল। কিচ্ছু ভয় কোরো না দেওয়ানজি। নরমের জোর সব চেয়ে বড়ো জোর, আমাদের ভালোমানুষ কুমুর কাছে ওই গোঁয়ারকে পোষ মানতেই হবে, এ আমি বলে দিলুম।
বিপ্রদাসের প্রবেশ। অখিলের প্রস্থান
নবগোপাল। এ কী! বড়োবাবু যে! ডাক্তার যে তোমাকে বিছানা থেকে এক পা নড়তে বারণ করেছেন!
বিপ্রদাস। যখন শেষের সে দিন ভয়ংকর আসবে তখন নড়ব না, তোমাদের ভাবতে হবে না। এখন বেঁচে আছি। দেখেশুনে বেড়াবার মতো দেহের অবস্থা নয়, তাই তোমাদের কাছে খবর নিতে এলুম।
নবগোপাল। সব চেয়ে বড়ো খবরটা এই যে, জামাইবাবু আমাদের কাশীর উপর আড়ি করে ব্যাসকাশী বানাতে বসেছেন। ঘোষালদিঘির পানা সব তোলানো হয়ে গেল। ঘাটে একজোড়া পাল খেলাবার বিলিতি নৌকা— একটার গায়ে লেখা মধুমতী, আর-একটার গায়ে মধুকরী। রাজাবাহাদুরের তাঁবুর সামনে হলদে বনাতের উপর লাল রেশমে বোনা নাম লেখা মধুচক্র। ঘাটের উপরেই নিমগাছটার গায়ে কাঠের পাটায় লেখা মধুসাগর। কলকাতা থেকে ত্রিশটা মালী এসে লেগেছে এক রাত্তিরে বাগান বানিয়ে ফেলতে, যার নাম হয়েছে মধুকুঞ্জ। বাগানের সামনে লোহার গেট বসেছে, নিশেন উড়ছে, তাতে লেখা মধুপুরী। আর লাল-উর্দি-পরা তকমা-ঝোলানো পাইক বরকন্দাজ পায়ে পায়ে নুরনগরের বুকে বিলিতি বল্লমের খোঁচা দিয়ে দিয়ে চলেছে।
বিপ্রদাস। ধৈর্য ধরতে হবে নবু। এই সেদিন মধুসূদন ফাঁকা খেতাব পেয়েছে রাজা, এখানে এসে সাধ মিটিয়ে ফাঁকা রাজত্বের খেলা খেলে যেতে চায়। তাতে মনে মনে হাসতে চাও হেসো, কিন্তু দয়া কোরো, রাগ কোরো না।
নবগোপাল। তুমি সহ্য করতে পার দাদা, কিন্তু প্রজারা সইতে পারছে না। তারা বলছে ওদের উপর টেক্কা দিতে হবে, তাতে যত টাকা লাগে লাগুক।
বিপ্রদাস। নবু, আড়ম্বরে পাল্লা দেবার চেষ্টা, ওটা ইতরের কাজ। কী বল দেওয়ানজি?
দেওয়ানজি। তোমার মুখেই এমন কথা শোভা পায় বড়োবাবু, আমাদের ছোটো মুখে মানায় না।
নবগোপাল। চতুর্মুখ তাঁর পা ঝাড়া দিয়েই বেশির ভাগ মানুষ গড়েছেন। কেবল বড়ো বড়ো কথা বলবার জন্যেই তাঁর চারটে মুখ। পৃথিবীতে সাড়ে পনেরো আনা লোকই যে ইতর, তাদের কাছে সম্মান রাখতে হলে ইতরের রাস্তাই ধরতে হয়।
বিপ্রদাস। তাতেও পেরে উঠবে না ভাই, তার চেয়ে সাত্ত্বিকভাবে কাজ সেরে নিই, সে দেখাবে ভালো। উপযুক্ত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত আনিয়ে আমাদের সামবেদের মতে অনুষ্ঠান করা যাবে। ওরা রাজা হয়েছে, করুক আড়ম্বর ; আমরা ব্রাহ্মণ, পুণ্যকর্ম