কুমুদিনী। তোমাকে মনে হয় না নতুন চেনা। আপনাকে তোমার চিনিয়ে নিতে দেরি হয় না ভাই, তুমি সহজে ভালোবাসতে পার, সে কথা গোড়া থেকেই বুঝেছি।
মোতির মা। কী কথা ভাবছ আমাকে বলো ভাই, তোমার মন খোলসা হয়ে যাক।
কুমুদিনী। ক'দিন ধরে আমি ঠাকুরকে কেবলই বলেছি, আমি তোমাকে বড়ো বিশ্বাস করেছি, তুমি আমার বিশ্বাস ভেঙো না।
মোতির মা। বুঝতে পারি ভাই, তোমার কী যে হচ্ছে মনে। আমার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন তো ছিলুম কচি খুকি। মন তৈরিই হয় নি, মনের মধ্যে কিছুতেই কোনো খটকাই ছিল না। ছোটো ছেলে কাঁচা ফলটাকে যেমন টপ্ করে মুখে পুরে দেয়, স্বামীর সংসার তেমনি করেই আমাকে এক গ্রাসে গিলেছে, কোথাও কিছু বাধে নি। সবাই বললে ফুলশয্যে, হয়ে গেল ফুলশয্যে, সে একটা খেলা। কিন্তু তোমার এই ফুলশয্যে নিয়ে তোমার বুক যে কেঁপে উঠেছে, দোষ দেব কাকে! পর আপন হতে সময় লাগে। সে সময় যে কেউ দিতে চায় না। টাকা পেতে বড়োঠাকুরের কত যুগ লেগেছে, আর মন পেতে তার যে দুদিন সবুর সইবে না। যেমনি হুকুম অমনি হাজির!
কুমুদিনী। আমি তো মন দিতে সম্পূর্ণ তৈরি হয়েই এসেছিলুম এঁদের ঘরে, কিন্তু সে মন কি এমনি করেই নিতে হয় — এত অশ্রদ্ধা ক'রে, ছি ছি, এমন অপমান ক'রে! যে ভালোবাসা আমি ওঁকে দিতে এলুম, সে যে আমার ঠাকুরের প্রসাদ থেকে নেওয়া, বিয়ের আগে থেকেই পদে পদে তার অসম্মান ঘটেছে। এমন ব্যবহার যে কোথাও হতে পারে সে আমি মনে করতেও পারি নি, এ আমার একটুও জানা ছিল না, তাই আমি এত নির্ভয়ে এত বিশ্বাস নিয়েই এসেছিলেম।
মুখে কাপড় দিয়ে কান্না
মোতির মা। কেঁদো না, দিদি, কেঁদো না। আজকের দিনে তোমার চোখের জল এখানকার গৃহলক্ষ্মী সইবেন না।
কুমুদিনী। আজকে নিজের জন্যে আমার কান্না অন্যায় সে আমি জানি। আজকে সব কান্না আমার দাদার জন্যে। আজ তিনি রোগে বিছানায় পড়ে, সেই বিছানা থেকে তিনি আমাকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন।
বুকের কাপড় থেকে টেলিগ্রাম বের করলে
তিনি আশীর্বাদ করেছেন, ‘ ঈশ্বর তোমার কল্যাণ করুন। ' আজ সকাল থেকে সেই আশীর্বাদ আমি বুকে আঁকড়ে ধরে আছি — না, আজ আমি ভয় করব না, কোনো ভয় করব না। ঠাকুর, আজকের মতো আমাকে বল দাও।
মোতির মা। একটা কথা মনে রেখো রানীদিদি, বড়োঠাকুর তোমাকে ভালোবেসেছেন। ওঁর জীবনে এটা এমন অসম্ভব আশ্চর্য ঘটনা যে উনি ঠিকমতো করে তাকে মানিয়ে নিতে পারছেন না, তার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে ওঁর ব্যাবসাদারের ভাষা। আজ তো বাড়ি ভরা মেয়ে — তবু কতবার কাজকর্ম ফেলে ঘুরে ফিরে বাড়ির মধ্যে এসেছেন, কোনো ছুতোয় একবার তোমাকে দেখে যাবার জন্যে। মেয়েরা হাসাহাসি করেছে। একটা খবর তোমাকে দিয়ে রাখি। ঠিক তোমাদের চিঠির দিনেই উনি তারে খবর পেয়েছেন, তিসি চালানের কাজে ওঁর লাভ হয়েছে বিশ লাখ টাকা, সেই টাকায় তোমারই দাম বেড়ে গেছে, বিশ্বাস হয়েছে তুমি পয়মন্ত। এই সুযোগ নিয়ে তুমি যদি আপনার আসন জোর দখলে রাখতে পার উনি সাহস করবেন না তোমাকে অপ্রসন্ন করতে।