Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://xn--u5bxfcqewdax4kraj7ob.xn--45brj9c)
নূতন অবতার- তৃতীয় অঙ্ক, ৩
নূতন অবতার
ছিল সে-সমস্তই উঠে গেছে; রাত্তিরে যখন হরিবোল হরিবোল শব্দ ওঠে এবং শেয়ালগুলো ডাকতে থাকে তখন রক্ত শুকিয়ে যায়। স্ত্রী তো বাপের বাড়ি চলে গেছেন। বাড়িতে চাকর-দাসী টিঁকতে পারে না। ভূতের ভয়ে দিনে-দুপুরে দাঁতকপাটি খেয়ে খেয়ে পড়ে। চারটি রেঁধে দেয় এমন লোক পাই নে। রাত্তিরে নিজের পায়ের শব্দ শুনলে বুকের মধ্যে দুড় দুড় করতে থাকে; বাড়িতে জনমানব নেই; গঙ্গাযাত্রীর ঘর থেকে কেবল থেকে থেকে তারক-ব্রহ্ম নাম শুনি, আর গা ছম্ছম্ করতে থাকে। আবার হয়েছে কী; ছেড়েও যেতে পারি নে। আমার ভগীরথ নাম চতুর্দিকেই রাষ্ট্র হয়ে গেছে; সকলেরই দর্শন করতে ইচ্ছা হয়— সেদিন পশ্চিম থেকে দুজন এসেছিল, তাদের কথাই বুঝতে পারি নে। বেটারা ভক্তি করলে বটে, কিন্তু আমার থালাবাটিগুলো চুরিও করে গেছে। এখান থেকে উঠে গেলে হয়তো ঠিকানা না পেয়ে অনেকে ফিরে যেতে পারে। এ দিকে আবার বিষয়কর্ম দেখতে সময় পাচ্ছি নে; আমার পত্তনি তালুকটার খাজনা বাকি পড়েছে, শুনেছি জমিদার অষ্টম করবে। শরীর ভয়ে অনিয়মে এবং ব্যামোয় রোজ শুকিয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারে ভয় দেখাচ্ছে এ জায়গা না ছাড়লে আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। কী করি বলো তো দাদা? রুদদুর বক্শি ছিলুম, সুখে ছিলুম, কোনো ল্যাঠাই ছিল না; ভগীরথ হয়ে কোনো দিক সামলে উঠতে পারছি নে, আমার সোনার পুরী একেবারে শ্মশান হয়ে গেছে! আবার কাগজগুলো আজকাল আমার সঙ্গে লেগেছে; তারা বলে সব মিথ্যে। তাদের নামে লাইবেল আনবার জন্যে উকিলের পরামর্শ নিতে গিয়েছিলুম; উকিল বললেন, তুমিই যে ভগীরথ সেটা প্রমাণ করতে গেলে সত্যযুগ থেকে সাক্ষী তলব করতে হয়, স্বয়ং ব্যাসদেবের নামে সমন জারি করতে হয়। শুনে আমার ভরসা হল না। এখানকার লোকের মনেও ক্রমে সন্দেহ জন্মে গেছে। মতি গয়লানীর সঙ্গে একরকম ঠিক হয়েছিল আমি পাদোদক দেব আর সে দুধ দেবে, আজ দুদিন থেকে সে মাগী আবার তার হিসেব নিয়ে এসে উপস্থিত হয়েছে; ভাবে গতিকে স্পষ্ট বুঝতে পারছি টাকার বদলে আমি তাকে পায়ের ধুলো দিতে গেলে সেও আমার উপরে পায়ের ধুলো ঝেড়ে যাবে। ভয়ে কিছু বলতে পারছি নে। পুকুরটা তো গেছেই, আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যারাও ছেড়ে গেছে, চাকর-দাসীও পালিয়েছে, প্রতিবেশীরাও গ্রাম ছেড়ে নতুন বসতি করেছে, আমার ভগীরথ নামটাও টেঁকে কি না সন্দেহ, কেবল কি একা মা গঙ্গা আমাকে কিছুতেই ছাড়বেন না? মা গঙ্গাকে নিয়ে কি আমার সংসার চলবে? রাস্তায় বেরোলে আজকাল ছেলেগুলো ঠাট্টা করতে আরম্ভ করেছে যে, রুদদুর বক্শির গঙ্গাপ্রাপ্তি হয়েছে!— এই তো বিপদে পড়া গেছে। দাদা, আবার একবার তোমাকে স্বপন দেখতে হচ্ছে। দোহাই তোমার, দোহাই মা গঙ্গার, হুগলীর পুলের নীচে যদি তাঁর বাসের অসুবিধে হয়, দেশে বড়ো বড়ো ঝিল খাল দিঘি রয়েছে, স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবেন। আমার ঐ পুকুরের জল যেরকম হয়ে এসেছে আর দু দিন বাদে তাঁর মকরটা তার শুঁড়সুদ্ধ মরে ভেসে উঠবে; আমার মতো ভগীরথ ঢের মিলবে, কিন্তু ব্রাহ্মণ-কায়স্থের ঘরে অমন বাহন আর পাবেন না। এই নতুন গঙ্গার ধারে তাঁর স্নেহের ভগীরথও যে বেশিদিন টিকবে কোনো ডাক্তারেই এমন আশা দেয় না। সত্যযুগের নামটার জন্যে মায়া হয় বটে, কিন্তু আমি বেশ করে ভেবে দেখেছি, দাদা, এই কলিযুগের প্রাণটার মায়াও ছাড়তে পারি নে। তাই স্থির করেছি পুষ্করিণীটি তোমাকেই ফিরিয়ে দেব, কিন্তু গঙ্গা-মাতাকে এখান থেকে একটু দূরে বসত করতে হবে।