চন্দ্রকান্ত। সেজের বাতি নিবিয়ে দেবার ঠোঙাগুলোরও ঐরকম চেহারা। এই পঁচিশটা বৎসরের যত-কিছু শিক্ষাদীক্ষা, যত-কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা — ভারতের ঐক্য, বাণিজ্যের উন্নতি, সমাজের সংস্কার, সাহেবের ছেলে পিটোনো প্রভৃতি যে-সকল উঁচু উঁচ ভাবের পলতে মগজের ঘি খেয়ে খুব উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠেছিল সেগুলো ঐ টোপর চাপা পড়ে একদম নিবে যাবে।
শ্রীপতি। চন্দরদা, তুমি তো বিয়ে করেছ, বলো-না কী করতে হবে। হাঁ করে সবাই মিলে দাঁড়িয়ে থাকলে কি ‘ বিয়ে-বিয়ে ' মনে হয়?
চন্দ্রকান্ত। সে তো ভাই, স্টোন্-এজ্, আইস্-এজের কথা। সে যুগে না ছিল পূর্বরাগের কোমলতা, না ছিল অপূর্ব অনুরাগের উত্তাপ। কেবল বিবাহের যিনি আদ্যাশক্তি সেই মহামায়াই আজও আছেন অন্তরে-বাহিরে, আর সমস্তই ভুলেছি।
ভূপতি। শ্যালীর হাতের কানমলা?
চন্দ্রকান্ত। হায় পোড়াকপাল! শ্যালী থাকলে তবু বিবাহের সংকীর্ণতা অনেকটা কাটে, ওরই মধ্যে একটুখানি পাশ ফেরবার জায়গা পাওয়া যায় — শ্বশুরমশায় একেবারে কড়ায় গন্ডায় ওজন করে দিয়েছেন, সিকি পয়সার ফাউ দেন নি।
বিনোদ। বাস্তবিক, বর পছন্দ করবার সময় যেমন জিজ্ঞাসা করে কটি পাস আছে, কনে পছন্দ করবার সময় তেমনি খোঁজ নেওয়া উচিত কটি ভগিনী আছে।
চন্দ্রকান্ত। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। ঠিক বিয়ের দিনটিতে বুঝি চৈতন্য হল? নিতান্ত বঞ্চিত হবে না ; তোমার কপালে একটি আছে, নামটি হচ্ছে ইন্দুমতী।
গদাই। ( স্বগত) যাঁকে আমার স্কন্ধের উপর উদ্যত করা হয়েছে — সর্বনাশ আর-কি।
শ্রীপতি। বিনোদ, একটুখানি বোসো।
বিনোদ। না ভাই, তা হলে আর উঠতে পারব না, মনটা দেহের উপর যেন পাথরের কাগজচাপা হয়ে চেপে রাখবে।
ভূপতি। এসো তবে, বর-কনের উদ্দেশে থ্রী চিয়ার্স্ দিয়ে বেরিয়ে পড়া যাক। হিপ্ হিপ্ হুরে —
চন্দ্রকান্ত। দেখো, আমার প্রিয়বন্ধুর বিয়েতে আমি কখনোই এরকম অনাচার হতে দেব না ; শুভকর্মে অমন বিদেশী শেয়াল-ডাক ডেকো না। তার চেয়ে সবাই মিলে উলু দেবার চেষ্টা করো-না।
নলিনাক্ষ। এই তবে আমাদের অবিবাহিত বন্ধুত্বের শেষ মিলন। জীবনস্রোতে তুমি এক দিকে যাবে, আমি এক দিকে যাব। প্রার্থনা করি তুমি সুখে থাকো। কিন্তু মুহূর্তের জন্যে ভেবে দেখো বিনু, এই মরুময় জগতে তুমি কোথায় যাচ্ছ —
চন্দ্রকান্ত। বিনু, তুই বল্, মা, আমি তোমার জন্যে দাসী আনতে যাচ্ছি। তা হলে কনকাঞ্জলিটা হয়ে যায়।
শ্রীপতি। এইবার তবে উলু আরম্ভ হোক।
[ সকলে উলুর চেষ্টা ও প্রস্থান